তখন পশ্চিমে দিগন্ত পেরিয়ে ঢলে পড়ছে সূর্য। কুশিয়ারা নদীতে সূর্য ডুবো ডুবো। ‘সমস্ত দিনের শেষে’ ক্লান্ত পাখিরা যার যার কুলায় ফিরছে। বিকেলটা ধীরে ধীরে তরল সোনারঙে সন্ধ্যার কাছে সমর্পিত হতে চলেছে। জলের ওপর ভাসছে গোধূলিবেলার সেই রঙিন তিরতির করা ঢেউ। কেউ একা, কেউ দল বেঁধে সেই রঙিন জলে নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছেন। কেউ জলের বুকে নৌকা নিয়ে জালের ফাঁদ পেতে মাছ ধরছেন। কেউ কুশিয়ারার তীরে ভেসে থাকা ছায়াঘন একটুকরা দ্বীপে বসে আড্ডা দেন, কেউ চারদিকে জলের ভেতর হেঁটে বেড়ান। এখানে একদিকে কুশিয়ারা নদী, অন্যদিকে কাউয়াদীঘি হাওর। মাঝখানের এই জায়গাটুকু বিকেলবেলা ঘুরে বেড়ানোর একটুকরা আনন্দ-উদ্যান হয়ে উঠেছে।
মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কাশিমপুর পাম্পহাউস এলাকার এই স্থানে এখন বিকেল হলেই অনেক মানুষ বন্ধুবান্ধব, সপরিবার ছুটে যান। বর্ষায় এই স্থানটি বুকে-পাঁজরে জল নিয়ে যেন রূপের পসরা খুলে বসে। জল ও সমতলের বাহুজড়ানো খোলা প্রান্তরের এই স্থান স্থানীয় ও দূরাগত মানুষের উপস্থিতিতে গোধূলিবেলায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার আঁধার ঘন হয়ে এলে দিনের সব অবসাদ এখানে জমা রেখে, ধুয়েমুছে তবে যেন ঘুরে বেড়ানো মানুষ যাঁর যাঁর বাড়ির দিকে পা বাড়ান।
শুক্রবার বিকেলে চাঁদনীঘাট-হলদিগুল সড়ক ধরে কাশিমপুর পাম্পহাউসের দিকে যাওয়ার সময়টিতে বিকেল প্রায় সন্ধ্যার কাছাকাছি চলে এসেছে। এলাকাটিতে তখন স্থানীয় ও দূরাগত অনেক মানুষ। শিশু-নারীসহ অনেকে পাকা সড়কের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছেন। অনেকে দল বেঁধে নৌকা নিয়ে কুশিয়ারার জলে ভাসছেন। মাঝি তাঁদের এদিক-ওদিকে নিয়ে ঘুরছেন।
একদল তরুণ গলা ছেড়ে হাসন-লালনের গান ধরেছেন। কেউ নৌকায় যেন জল-যমুনা পার হয়ে একটুকরা দ্বীপের মতো জায়াগায় পৌঁছে গাছের ছায়াতে গিয়ে আসর জমিয়েছেন। খুব অল্প টাকাতেই নৌকা নিয়ে জলে ভাসার সুযোগ আছে। কেউ ঝাপজাল দিয়ে মাছ ধরছেন। কেউ নৌকা নিয়ে গভীর পানিতে জাল ফেলছেন। ছেলেরা জলের বুকে নেমে ডুবসাঁতার কাটছে, ফুটবল নিয়ে খেলছে। কেউ সেলফি তুলছেন, কেউ অন্যের ছবি তুলে দিচ্ছেন। পাম্পহাউসের পাশ ঘেঁষে সারি ধরে বেড়ে ওঠা সবুজ হুইপিং গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই পাখি এসে বসছে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ে লাফালাফি করছে। কিচিরমিচির করে একদম বাজার বসিয়ে দিয়েছে। এক ব্যক্তি নিজের পোষা একদল রাজহাঁস নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। সাদা হাঁসের শরীর থেকে ঠিকরে পড়ছে গোধূলির রং। কেউ সড়কের ওপর একা একাই ফুটবল খেলছেন। এ এক আনন্দঘন মুহূর্ত।
বর্ষায় কাউয়াদীঘি হাওরের অতিরিক্ত পানি সেচ দিয়ে কুশিয়ারা নদীতে ফেলে দিতে কাশিমপুরের স্থানটিতে পাম্পহাউস স্থাপন করা হয়েছে। হাওরে পানি বাড়লে যখন ফসল ডুবে যায়, মানুষের ঘরবাড়ি ও পথে পানি ওঠে; তখন পাম্পের মাধ্যমে সেচ দিয়ে সেই পানি কুশিয়ারা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
সূর্য ওপারে হারিয়ে যাওয়ার পথে। কুশিয়ারা নদীর জলে ডুবছে সূর্য। শেষবেলার রঙে মাখামাখি হয়ে আছে এই জল। সেই রঙিন জল ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে তিরতির ঢেউ খেলছে। অসংখ্য সোনালি জলের টুকরা তখন কুশিয়ারার বুকে। সূর্য বুঝিয়ে দিয়েছে আর বেশি বেলা নেই। পারে যাওয়ার সময় হয়েছে। একটু পরই অন্ধকার নামবে। চরাচর ডুববে অন্ধকারে। উপস্থিত লোকজনের মধ্যেও তারই ছায়া পড়েছে। সবাই যাঁর যাঁর মতো স্থানটি ছাড়তে শুরু করেন। এ যেন জীবনানন্দ দাশের সেই সন্ধ্যা কবিতার পঙ্ক্তি, ‘সন্ধ্যা হয়Ñচারিদিকে মৃদু নীরবতা/ কুটা মুখে নিয়ে এক শালিখ যেতেছে উড়ে চুপে...।’
চারদিকে মৃদু নীরবতার মধ্যে ফেরার পথে চোখে পড়ে তিনটি খালি নৌকা পারে ভেড়ানো আছে। তবে ‘বেলা যে পড়ে এল’ এ রকম পারাপারের হাঁকডাক নেই। মাঝি নেই, যাত্রী নেই। ঘাটজুড়ে সন্ধ্যা নামার শূন্যতা শুধু!