
ময়মনসিংহ নগরের কাছারিঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে ভেসে আসছিল বাঁশির করুণ সুর। নদের মাঝখানে হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে এক তরুণ বাজাচ্ছেন বাঁশের বাঁশি। তাঁর চারপাশে আরও অনেক তরুণ দাঁড়িয়ে। তাঁদের মুখেও বিষাদের ছাপ। পেছনে নৌকার পালের মতো সাদা একটি কাপড়ে লেখা ‘মৃতের চিৎকার’।
ব্রহ্মপুত্রের বুকে হাঁটুপানিতে সাজানো হয় প্রতীকী মঞ্চ। একটি টেবিলে রাখা হয় কিছু খাবার; কিন্তু পানি ছিল না। প্রতীকী এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ময়মনসিংহ নগর এবং বিভিন্ন উপজেলা থেকে তরুণ-তরুণীরা যোগ দেন।
তাঁদের দাবি, ২০১৯ সালের ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দে ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্প শুরু হয়। প্রথমে খনন করা হয় ময়মনসিংহ নগরের কাছারিঘাট এলাকায়। এর পরের বছর থেকে শুষ্ক মৌসুমে চর জাগছে নদে। অথচ খননের আগেও কখনো এমন চর দেখা যায়নি। ব্রহ্মপুত্রে কখনো এত কম পানি ছিল না।
তরুণদের অভিযোগ, খননের নামে আসলে ব্রহ্মপুত্র নদকে মেরে ফেলা হচ্ছে। খনন করে বালু নদের পাড়ে রাখার কারণে সেসব এলাকা অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যাচ্ছে। যে কারণে ব্রহ্মপুত্র নদ এখন মরে গেছে।
খনন প্রকল্পের শুরুতে এ প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন রাকিবুল ইসলাম খান। এক বছর আগে এ প্রকল্প থেকে বদলি হয়ে গেছেন তিনি। শুক্রবার তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নদ-নদীতে চর জাগবে, এটাই স্বাভাবিক। পানির প্রবাহ সৃষ্টি হলে চর আর জাগবে না। এটি হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। জুলাই থেকে কাছারিঘাট এলাকায় আবারও খননকাজ পুরোদমে শুরু হবে।
খননের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মহসিন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সালে কাছারিঘাট এলাকায় খনন হয়। তবে বর্ষাকালে উজান থেকে পলি এসে নদে চর পড়ছে। সম্প্রতি আমি ওই এলাকাটি পরিদর্শন করেছি। দুই–এক দিনের মধ্যে আবারও ওই এলাকায় খননকাজ শুরু হবে।’
আজ শুক্রবার দুপুরের এ প্রতিবাদ কর্মসূচিতে রতন সরকার নামের একজন স্বেচ্ছাসেবী বলেন, ‘৫০ বছরের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ কখনো এত পানিশূন্য দেখিনি।’ তাঁর এ বক্তব্যের পর তরুণেরা ব্রহ্মপুত্রের হয়ে চিৎকার করে ওঠেন। দুই ঘণ্টাব্যাপী চলা প্রতীকী প্রতিবাদে ময়মনসিংহের তরুণ শিল্পীরা হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে গান পরিবেশন করেন। এ সময় সবাই হাঁটুপানিতে নেমে একসঙ্গে মৃত ব্রহ্মপুত্র সেজে চিৎকার করেন।
এর উদ্যোক্তা তরুণ কবি ও সংগঠক শামীম আশরাফ শুরুতে বলেন, ‘খননের অশুদ্ধাচারের কারণে আজ ব্রহ্মপুত্রের এমন দশা। খননের পর ব্রহ্মপুত্রে শুধু বালু আর বালু। আমরা এমন বালুর সৌন্দর্য চাই না। আমরা চাই স্রোতোস্বিনী ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রতীকী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা ব্রহ্মপুত্রকে মেরে ফেলার প্রতিবাদ করছি। মৃত ব্রহ্মপুত্রের হয়ে চিৎকার করছি। আমরা চাই, আমাদের এ চিৎকার কারও কাছে পৌঁছাক।’
বিআইডব্লিউটিএ ২০১৯ সালে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার মোট ২২৭ কিলোমিটার ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ শুরু করে। ২০২৪ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
তবে শুরু থেকে ময়মনসিংহের সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতারা এ খননকাজের সমালোচনা করে আসছেন। প্রকল্প অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্রের কোথাও কোথাও প্রস্থে মাত্র ১০০ মিটার খনন করা হচ্ছে। গভীরতা সর্বোচ্চ ছয় মিটার। শুরু থেকে খনন করে বালু রাখা হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়েই। বর্ষাকালে ওই বালু আবারও গড়িয়ে পড়ে নদে। যে কারণে নদ খননের এ প্রকল্পে অনেকেই ব্রহ্মপুত্রকে খালে পরিণত করার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
২০১৯ সালে প্রকল্প শুরু হলে একেবারে প্রথম দিকে খনন করা হয় ময়মনসিংহ নগরের কাছারিঘাট এলাকায়। তবে ২০২১ সালের নভেম্বরে প্রথম ওই এলাকাজুড়ে ছোট ছোট চর জাগতে দেখা যায়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু করেন নগরবাসী। পরে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর প্রকল্পের কর্মকর্তারা চর জাগার কারণ জানাতে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে বলা হয়, প্রাকৃতিক কারণে পলি জমে চর পড়ছে। যেসব এলাকায় চর পড়েছে, সেসব এলাকায় আরও খনন হবে।