শেরপুরের নকলা উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার। সম্প্রতি তোলা
শেরপুরের নকলা উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে ভাঙনে নিঃস্ব শতাধিক পরিবার। সম্প্রতি তোলা

‘গত বছর আবাদি জমি নদে গ্যাছে, অহন বাড়ি ভাঙনে পড়ছে’

শেরপুরের নকলা উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছেন হাছনা ভানু (৪৬)। স্বামীহারা এই নারী বর্তমানে কেজাইকাটা ঘাটে একটি ছোট চা-পানের দোকান দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাচ্ছেন। নদভাঙনে তিন দফায় তাঁদের ৮০ শতাংশ জমিসহ বাড়িভিটা বিলীন হয়ে গেছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী স্বামী আজাহার আলী ও সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বোনের বাড়িতে। সেখানে মারা যান স্বামী। এরপর তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন হাছনা।

সম্প্রতি নদের গর্ভে বসতবাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়া স্থান দেখিয়ে হাছনা ভানু আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভাঙনে চক্ষের সামনে সব শ্যাষ অইয়া গেছে। শ্যাষ বার ভাঙনে মধ্য রাইতে কোনো রহম পঙ্গু স্বামী সন্তান লইয়া বাইচা ফিরছি। তখন যদি ভাঙন ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা অইতো, তাইলে আমগর মতো মানুষের নিঃস্ব অইয়া পরুন লাগতো না।’

হাছনা ভানুর এই আক্ষেপ চর অষ্টধর ইউনিয়নের আরও শতাধিক পরিবারের। উপজেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ঘেঁষা নারায়ণখোলা দক্ষিণ, রায় অষ্টধর ও ভেবুয়ারচর গ্রামে গত ছয়-সাত বছরে বাড়িঘর ও ফসলি জমি হারিয়েছেন তাঁরা। অনেকে নদীর ওপারে জেগে ওঠা চরে বসতি গড়েছেন। কেউ আবার কাজের খোঁজে এলাকা ছেড়েছেন। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। সরকারি সহায়তা না থাকায় এসব পরিবার ক্রমে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, প্রতিবছর বর্ষায় নদীতে পানি বাড়লে তীব্র স্রোতের কারণে শুরু হয় ভাঙন। ভাঙনরোধে কোনো টেকসই ব্যবস্থা না থাকায় নতুন করে আবারও প্রায় দুই-তিন কিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

নদের গর্ভে বসতবাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়া স্থান দেখাচ্ছেন হাছনা ভানু

স্থানীয় বাসিন্দা মো. হযরত আলী (৬৫) বলেন, ‘গত বছর আবাদি জমি নদে গ্যাছে, অহন বাড়ি ভাঙনে পড়ছে। বাঁধের ব্যবস্থা না অইলে আমরা পুরাটাই হারামু।’ ভেবুয়ারচর গ্রামের গৃহবধূ আশুরা বেগম (৫০) বলেন, ‘মেলা আগেই আমাগো ঘরবাড়ি নদের পেটে চইলা গেছে। অহন অন্যের বাড়িতে পুলাপান লইয়া থাকি। কেউ কোনো সাহায্য করে নাই।’

স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবর খান বলেন, গত দুই মাসে প্রায় ৫০০ মিটার নদী পাড়ে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পানি এলেই এই জমিগুলো নদীতে গায়েব হইয়া যাইব।’ এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভাঙনরোধ করতে হবে।

এ বিষয়ে শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০২২ সালে নারায়ণখোলা দক্ষিণ এলাকায় ১৬০ মিটার, ২০২৩ সালে ১৩০ মিটার এবং ২০২৪ সালে ৭৬ মিটার এলাকায় জিওব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে কিছুটা ফল মিললেও প্রয়োজন আরও বিস্তৃত বাঁধ। ইতিমধ্যে আরও এক কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া গেছে। প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে আরও দুই কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণের জন্য।

নকলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এখানে সদ্য যোগদান করেছি। নদভাঙনের এলাকা পরিদর্শনে যাব এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সঙ্গে কথা বলব। তাদের জন্য কী ধরনের সরকারি সহায়তা দেওয়া যেতে পারে, তা খতিয়ে দেখা হবে।’

শেরপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আখিনুজ্জামান বলেন, নদীভাঙন রোধে আরও এক কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া গেছে। আশা করি দ্রুত কাজ শুরু হবে। বাকি অংশের জন্যও প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।