
দুই মেয়ে কেঁদে চলেছে অবিরত। কাঁদছেন স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরাও। রিমিন আক্তারের সেদিক মন নেই। তাঁর চোখে ছলছল করছে পানি, তবে কোথায় যেন আটকে গেছেন তিনি। একপর্যায়ে যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন, এ সময় রিমিন আক্তারের গাল বেয়ে ঝরে পড়ল চোখের পানি।
রিমিন বললেন, ‘সকালে দুই মেয়েকে নিয়ে আমার বাবার বাড়ি গিয়েছিলাম। তিনি (মঞ্জুর) ঘর থেকে আমাদের সুন্দরভাবে বিদায় দিয়েছেন। বাবার বাড়ি পৌঁছার পর কয়েকবার মঞ্জুরের সঙ্গে মোবাইলে কথাও হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই একটি ফোনকলে জানতে পারি, তিনি (স্বামী) সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। এটা শোনামাত্রই আমার পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে গেছে। মুহূর্তেই সব শেষ। পুরো পরিবার নিয়ে এখন আমি অথই সাগরে।’
কথার মধ্যেই কিছুটা সময়ের জন্য আবারও যেন কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন রিমিন আক্তার। এরপর আবার বলতে লাগলেন, ‘মেয়েটা এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাতে তিনি (স্বামী) কী খুশি। মেয়ে কোথায় ভর্তি হবে, কীভাবে পড়বে—এসব নানা বিষয় নিয়ে কয়েক দিন ধরে আলোচনা করছিলেন। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই নাই হয়ে গেলেন তিনি। এটা ভাবতেই মেয়েরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে মেয়েটার লেখাপড়াও।’ তাঁদের সান্ত্বনা দিতে এসে কাঁদছেন স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরাও।
আজ শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় একটি বালুভর্তি ট্রাকচাপায় নিহত হন গাজীপুরের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মঞ্জুর হোসেন (৫৮)। তিনি গাজীপুর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা গাজীপুর দর্পণ-এর সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি দৈনিক ভোরের দর্পণ ও দৈনিক করতোয়ার গাজীপুর প্রতিনিধি ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি গাজীপুর সিটি প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। তাঁর বাড়ি কাপাসিয়া উপজেলার পাবোর গ্রামে।
স্বজনেরা জানিয়েছেন, কাজের সূত্রে মঞ্জুর হোসেন গাজীপুর শহরে থাকতেন। আজ সকালে শহর থেকে নিজ বাড়ির উদ্দেশে মোটরসাইকেলে করে রওনা দেন তিনি। কাপাসিয়া উপজেলার কাপাসিয়া-ভাকুয়াদি সড়কের কোটবাজালিয়া এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগতির ট্রাক তাঁকে চাপা দেয়। এতে তাঁর শরীরের বেশির ভাগ অংশ ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
রিমিন আক্তার নিজে অসুস্থ, মেয়েরাও এখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাদের স্বাবলম্বী হতে এখনো অনেকটা পথ বাকি। মঞ্জুর হোসেন ছিলেন পুরো পরিবারের অবলম্বন।
মঞ্জুর হোসেনের পরিবারে স্ত্রী, দুই মেয়েসহ রয়েছেন বৃদ্ধ মা। গাজীপুরের জয়দেবপুর-কাপাসিয়া সড়কের পাবোর মোড় থেকে খানিকটা পশ্চিম দিকে এগোলে মঞ্জুর হোসেনের বাড়ি। শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো পরিবারে চলছে মাতম। উঠানে ভিড় করেছেন মঞ্জুর হোসেনের বন্ধু, সহকর্মী ও পাড়া-প্রতিবেশীরা। এর মধ্যেই দুই মেয়ে মেহরিন মঞ্জুর ইকরা (১৭) ও মিনহা মঞ্জুর সারার (১০) কান্নার শব্দ ঘর থেকে আসছিল বাইরে।
রিমিন আক্তার নিজে অসুস্থ, মেয়েরাও এখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাদের স্বাবলম্বী হতে এখনো অনেকটা পথ বাকি। মঞ্জুর হোসেন ছিলেন পুরো পরিবারের অবলম্বন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন সোনার সংসার। বড় মেয়েটা এবার এসএসসি পাস করেছে। ছোট মেয়েটাও পড়ছে স্কুলে। টেনেটুনে বেশ ভালোই চলছিল সংসার। কিন্তু এক মুহূর্তের সড়ক দুর্ঘটনায় সব পাল্টে গেল।
রিমিন আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘এটা পরিকল্পিত হত্যা। আমার স্বামীকে ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’
ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ মা হাফেজা খাতুন (৭৪)। বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না ছেলে হারানোর শোকে। স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কিন্তু মায়ের মন তাতে কি আর মানে। বিলাপ করে বলছিলেন, ‘আমি আর কিছু চাই না, শুধু চাই আমার ছেলেরে। তোমরা আমার বুকের মানিককে আইনা দাও। ও আল্লাহ, আমার কী সর্বনাশ হইয়্যা গেল। এহন আমার পোলার বউ, মাইয়্যাগরে ক্যাডায় দেখব। আমি আমার পোলার হত্যার বিচার চাই।’