
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সমাবর্তন বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন গ্রাম জোবরার নারীরা তাঁকে নতুন ধরনের অর্থনীতি শিখিয়েছেন। তাঁদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার মন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন তিনি। আর এই সবকিছুই ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে পড়াতে এসে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগেই গ্রামীণ ব্যাংকের সূচনা হয়েছিল।
আজ বুধবার বেলা তিনটা ছয় মিনিটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে স্থাপিত মঞ্চে সমাবর্তন বক্তৃতা দিতে ওঠেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বক্তৃতায় তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা, দেশের অর্থনীতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষকজীবন ও সমাবর্তনে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বহু বছর পর এই ক্যাম্পাসে ফিরে আসা আমার জন্য ভীষণ আনন্দের ব্যাপার। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এসেছিলাম ১৯৭২ সালে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা সবে শুরু। শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি, কী পরিবর্তন হতে যাচ্ছে আমার ভেতর। এর মধ্যে ১৯৭৪ সালে বিরাট দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। সবকিছু ওলটপালট করে দিল। মনের মধ্যে বহু জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হলো। মনে মনে ভাবতাম, সারা বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর ক্ষমতা আমার নাই। কিন্তু দেশের একটি ক্ষুদ্র অংশের কয়েকটি পরিবারের দুর্ভিক্ষ যদি ঠেকাতে পারি, সেটি আমার বড় তৃপ্তির বিষয় হবে। সে কারণে নজর পড়ল পাশের গ্রাম জোবরার দিকে। জোবরায় তখন কেউ মারা যায়নি। কিন্তু অবস্থা খুব কাহিল। সেখানে বিশাল জমি আছে, কিন্তু বৃষ্টি না হলে চাষ হয় না। মনে প্রশ্ন জাগল, বিশ্ববিদ্যালয় তো জ্ঞানের ভান্ডার। এই জ্ঞান পাশের গ্রামে উপচে পড়ে না কেন? তখন থেকেই জোবরায় আমার কাজ শুরু।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি এখানে এসেছিলাম শিক্ষক হয়ে। দেখলাম, ক্লাসরুমে যা পড়ানো হচ্ছে, বাস্তবের সঙ্গে তার মিল নেই। ক্রমে ক্রমে আশপাশের গ্রামে যে মহিলারা রয়েছেন, তাঁরাই আমার শিক্ষক হয়ে গেলেন। তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখলাম।’
জোবরা গ্রামের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যেসব নারীকে নিয়ে তিনি ক্ষুদ্রঋণের পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করেন, তাঁরা অনেকে নিজেদের নামও জানতেন না। তাঁরা কারও মা, কারও স্ত্রী, কারও–বা কন্যা হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু অল্প কিছু টাকা ঋণ পেয়ে তাঁরা অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি জোবরা গ্রামের মহিলাদের থেকে নতুন এক অর্থনীতি শিখতে শুরু করেছি। আজ যা কিছু করছি, সেটা মূলত সেখান থেকে শেখা। আমি বুঝতে পেরেছি, আমরা ব্যবসাকেন্দ্রিক একটা সভ্যতা গড়ে তুলেছি। এ সভ্যতা আত্মঘাতী। এ সভ্যতা টিকবে না। এ বিদ্যায় পৃথিবী ধ্বংস হবে। এর থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। আমাদের নতুন করে সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে।’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি যখন বললাম, ঋণ মানুষের মানবিক অধিকার, তখন অনেকেই হাসাহাসি করলেন। তাঁরা বললেন, অর্থনীতিতে তো অধিকারের কথা বলা নেই। আমি ভাবলাম, তাই তো, অর্থনীতিতে তো অধিকারের কথা বলা নেই। তাও আবার মানবিক অধিকার। একটা খটকার পরে আরেকটা খটকা। তারপর আমরা দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর কথাও বলেছি। অনেকে বিরোধিতা করেছে। বিরোধিতা করতেই পারে। কিন্তু আমি আমার কাজ করে গেছি।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমার সমস্ত ভাবনার বীজ বপন হয়েছে এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ জন্য আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। কোনো দিন নোবেল পুরস্কার পাওয়া যাবে, এটা মনে আসেনি। তবে এর বড় অংশীদার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় নোবেলের দাবিদার। এখানেই এসব চিন্তার সূত্রপাত।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আমাদের নিজেদের হাতে। আমরা যেভাবে বিশ্ব গড়তে চাই, সেভাবেই গড়তে পারি। আমি যেভাবে বলেছি, সেভাবে গড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি আমার কথাটা বলেছি, অন্যরা অন্যদের কথা বলবে, তোমরা তোমাদের কথা বলবে। এটাই আমার আবেদন। কিন্তু মনের মধ্যে স্বপ্ন থাকতে হবে যে আমরা কী ধরনের বিশ্ব চাই, কী ধরনের সমাজ চাই, কী ধরনের সংসার চাই, কী ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা গড়তে চাই। এগুলো আমাদের বের করে নিতে হবে।’
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৭২ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে আজ সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি প্রদান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উপাচার্য ইয়াহ্ইয়া আখতার অধ্যাপক ইউনূসের হাতে ডিলিট ডিগ্রির সনদ তুলে দেন।