
বন বিভাগের স্টাফ কোয়ার্টারের ছোট্ট একটি আধা পাকা টিনশেড কক্ষে দরজা-জানালা বন্ধ। বাইরে বসে পাহারা দিচ্ছেন বন বিভাগের কয়েকজন কর্মী। এই ঘরের মধ্যেই রাখা হয়েছে সীমান্ত এলাকায় গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়া নীলগাইটিকে। ছোট্ট ঘরের ভেতর কখনো দাঁড়িয়ে, আবার কখনো শুয়ে সময় কাটছে প্রাণীটির। মাঝে মাঝে মুখে নিচ্ছে খাবার। দেখতে আসা লোকজন জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছেন। সামান্য আওয়াজ পেলেই কান খাড়া করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে নীলগাইটি।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে পঞ্চগড় পৌরসভার কায়েতপাড়া এলাকায় পঞ্চগড় বন বিভাগ কার্যালয়ে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে। গতকাল বুধবার পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা পূর্ব জয়ধরভাঙ্গা এলাকায় গ্রামবাসীর হাতে আটক হওয়া স্ত্রী নীলগাইটিকে চিকিৎসা দেওয়ার পর এভাবেই বদ্ধ ঘরে রাখা হয়েছে।
নীলগাইটিকে যে কক্ষে রাখা হয়েছে, তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আনুমানিক ৮ বাই ৬ ফুট হবে। স্টাফ কোয়ার্টারের ওই কক্ষটি একসময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে জানা গেছে।
তবে চিকিৎসার জন্য সাময়িকভাবে সেখানে রাখা হলেও ওই বন্য প্রাণীটির জন্য তা উপযুক্ত পরিবেশ নয় বলে জানিয়েছেন পঞ্চগড় সামাজিক বনায়ন ও প্রশিক্ষণ নার্সারির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হরিপদ দেবনাথ। ছোটাছুটি করায় নিরাপত্তার স্বার্থে সেখানে রাখা হয়েছে দাবি করে তিনি জানান, প্রাণীটিকে খুব দ্রুত গাজীপুরের সাফারি পার্কে পাঠানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
এর আগে বুধবার দুপুরের দিকে চাকলাহাট ইউনিয়নের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা প্রধান পাড়া এলাকায় ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলের খেতে ছোটাছুটি করছিল নীলগাইটি। প্রথমে এটিকে কেউ হরিণ, আবার কেউ ঘোড়া ভেবে তাড়া করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে উৎসুক লোকজন বাড়তে থাকলে শতাধিক মানুষ প্রাণীটির পেছনে ছুটতে থাকেন। পরে প্রায় তিন কিলোমিটার দৌড়ে চাকলাহাট ইউনিয়নের পূর্ণ জয়ধরভাঙ্গা এলাকায় পাঙ্গা নদীতে ঝাঁপ দেয়। পরে সেখানে লোকজন প্রাণীটিকে ঘেরাও করে ধরে ফেলেন। এর মধ্যে বিজিবির জয়ধরভাঙ্গা বিওপির সদস্যরা সেখানে গিয়ে নীলগাইটিকে উদ্ধার করেন। খবর পেয়ে বন বিভাগের কর্মীরা সেখানে গেলে বিজিবি বিকেল সোয়া চারটার দিকে নীলগাইটি তাঁদের হাতে তুলে দেয়। পরে বন বিভাগের কর্মীরা প্রাণীটিকে পঞ্চগড় সদর উপজেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেন। পরে সন্ধ্যায় নীলগাইটিকে বন বিভাগ কার্যালয়ে নিয়ে সেখানে স্টাফ কোয়ার্টারের একটি কক্ষে রেখে খাবার দেওয়া হয়।
নীলগাইটি সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাঁটাতারের বেড়া পার হতে গিয়ে এটি কানসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পেয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নীলগাইটি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা পঞ্চগড় বন বিভাগের অফিস সহায়ক সৈয়দ আলী বলেন, ‘রাতে আমরা চারজন পাহারায় ছিলাম। রাতে নেপিয়ার ঘাস, লালশাক, কাঁঠালপাতা ও পানি দিয়েছি। সেগুলো খেয়েছে। রাতের বেশির ভাগ সময়ই নীলগাইটি দাঁড়িয়ে ছিল। ভোরে শুইছে। সকালে আবার দাঁড়িয়ে ঘাস খেয়ে বেলা দুইটার দিকে শুয়ে পড়েছে। একটু আওয়াজ পেলেই ছোটাছুটি করার চেষ্টা করছে। কালকের চেয়ে এখন বেশি সবল মনে হচ্ছে।’
বন বিভাগের পঞ্চগড় সদর উপজেলা বিট কর্মকর্তা জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘পঞ্চগড় সীমান্ত এলাকা হওয়ায় এখানে মাঝেমধ্যেই এ ধরনের বন্য প্রাণী ধরা পড়ে। কিন্তু আমাদের বন বিভাগে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য আলাদা কোনো কর্মকর্তা নাই। এমনকি আমাদের কারও সে রকম কোনো প্রশিক্ষণও নাই। এখানে কোনো বন্য প্রাণী রাখার পৃথক কক্ষ বা খাঁচাও নাই। এ জন্য স্টাফ কোয়ার্টারেই রাখতে হচ্ছে।’
পঞ্চগড় সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মরিয়ম রহমান বলেন, ‘আজকে (বৃহস্পতিবার) সকালে গিয়ে নীলগাইটিকে দেখে এসেছি। গতকাল যেসব ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করা হয়েছে, সেগুলোর উন্নতি হয়েছে। নীলগাইটি স্বাভাবিক প্রস্রাব-পায়খানা করেছে। ধরা পড়ার দিনের চেয়ে প্রাণীটির শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে।’