কোহিনুর (৪০) এখন পাটজাতীয় পণ্য তৈরি করেন এবং প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন
কোহিনুর (৪০) এখন পাটজাতীয় পণ্য তৈরি করেন এবং প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেন

মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিবেদনের সেই কোহিনুর কেমন আছেন

‘পায়রাবন্দের প্রতিটি মৌজা ও গ্রামে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। সাত বছর আগে গ্রাম জরিপকালে শখানেক মেয়ে কিংবা ছেলে পেয়েছিলাম যাদের বাল্যবিবাহ হয়েছে। ’৯২ সালের মার্চে গোটা ত্রিশেক ঘটনা অবগত হই। এগুলোর মধ্যে কোহিনুর ও শহীদুলের (প্রকৃত নাম শাহীদুল) বিয়ের ব্যাপারটি আমাকে নাড়া দেয়। নিজেদের কোনো ছেলে হয়নি বলে নাবালিকা কোহিনুরের বিয়ে দিয়েছিল ওর মা-বাবা।’

কথাগুলো ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’ বইতে লেখেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন। সাত বছর বয়সে কোহিনুরের বিয়ে হয়। তখন সে পায়রাবন্দ প্রাইমারি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত।

রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মস্থান। এই পায়রাবন্দে শিশু-বাল্যবিবাহ, অসম বিবাহ, যৌতুক, নির্যাতনসহ বাস্তব ঘটনা নিয়ে লেখা মোনাজাতউদ্দিনের ওই সময়ের প্রতিবেদন ও বই আলোচিত হয়। সেই থেকে আলোচিত কোহিনুরও।

চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন

কোহিনুর এখন কেমন আছেন, তা জানতে ৭ ডিসেম্বর ওই পরিবারের কাছে যাওয়া। রংপুর থেকে মডার্ন হয়ে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রে যাওয়ার পথে জয়রামপুর আনোয়ার গ্রাম। এই গ্রামে সড়কের পাশে কোহিনুরের বাবা খলিলুর রহমান (৭০) গালামালের দোকান করেন। সেখানে গেলে কোহিনুরের মা আছিরন নেছা (৭০) দোকানসংলগ্ন তাঁদের ‘অনেক আশা মহিলা কুটির শিল্প মহিলা সমিতি’র প্রদর্শনী কেন্দ্রে বসতে দিলেন। কিছুক্ষণ পর সেখানে এলেন কোহিনুর। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি পাশাপাশি।

কোহিনুরের বয়স এখন ৪০ বছর। তিন ছেলে তাঁর। স্বামী শাহীদুল ইসলাম কৃষিকাজ করেন। গরু-বাছুর দেখাশোনা করেন। মাঝেমধ্যে রিকশাও চালান। কোহিনুর বললেন, ‘জীবন মানে যুদ্ধ। যাঁদের কিছু থাকে না, তাঁদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা লাগে।’

গল্পে গল্পে জানা গেল, কোহিনুর তাঁর মায়ের কাছ থেকে পাটজাতীয় দ্রব্য থেকে পণ্য তৈরি শিখেছেন। তিনি এখন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। আক্ষেপ পড়াশোনা শিখতে না পারার। কোহিনুর বলেন, ‘আমার মায়ের পুরো সমর্থন আমার প্রতি। কোনো কাজে কখনো বাধা দেয়নি। তবে একটাই ভুল করেছে আমাকে ছোটতে বিয়ে দিয়ে। তারপরও লেখাপড়া করতে চেষ্টা করতাম। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলে, “ওতো লেখাপড়া করি কী হবে?” ১২ বছর বয়সে যেদিন ছেলেটা জন্ম নিল, তখন লেখাপড়া শেষ।’

কোহিনুর জানান, যখন কোনো প্রকল্পে প্রশিক্ষক পদে আবেদন করেন, তখন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ চায়। দিতে না পারার কারণে কাজ পান না। তিনি বলেন, ‘আমি আটকে যাই লেখাপড়ার একটি সার্টিফিকেটের কারণে। এ জন্য আমাকে নেওয়া হয় না। যখন বিভিন্ন মিটিংয়ে যাই, অনেকে ইংরেজিতে কথা বলে। আমি পারি না। লেখাপড়ার দিক দিয়ে আমি আটকে যাই; কিন্তু কাজের দিক দিয়ে আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।’

আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কোহিনুর তিন ছেলেকে পড়ালেখা করাচ্ছেন। বড় ছেলে নূর মোহাম্মদ ডিগ্রি পরীক্ষা দিয়ে এখন একটি এনজিওতে চাকরি করছেন। মেজ ছেলে এইচএসসিতে পড়েন। ছোট ছেলে লিটন অষ্টম শ্রেণিতে। তাঁর বড় দুই ছেলে নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছেন। তবু তিনি চান, তাঁরা লেখাপড়া ধরে রাখুক।

লেখাপড়ার প্রতি ‘অদম্য’ ইচ্ছার কথা জানান কোহিনুর। তিনি বলেন, ‘বেগম রোকেয়া যখন পড়ালেখা করতেন, তখন মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। বইয়ে পড়েছি, উনি রাতের বেলায় ওনার ভাইয়ের কাছে পড়তেন মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে আটজন মহিলাকে তৈরি করেছেন প্রথমে স্কুল খোলার জন্য। আমি এখনো পড়ি। লেখাপড়া ছাড়া কিছু হয় না। চেষ্টা করেছিলাম উন্মুক্ততে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু কাজের চাপে পারিনি।’  

‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’ বইয়ের প্রচ্ছদ। এতে পায়রাবন্দে শিশু-বাল্যবিবাহ, অসম বিবাহ, যৌতুক, নির্যাতনসহ বাস্তব ঘটনা নিয়ে মোনাজাতউদ্দিনের বিভিন্ন প্রতিবেদন স্থান পেয়েছে

৭ বছরের মেয়ে কোহিনুরকে বিয়ে দেওয়ার পেছনে ছিল আছিরন-খলিলুর দম্পতির দৈন্যদশাও। মোনাজাতউদ্দিন লেখেন, ‘খলিলুর রহমান আগে ছিল ক্ষুদ্র কৃষক। জমি হারিয়ে দিনমজুর। কিন্তু একেই মজুরি কম তাতে আবার কাজ জোটে না নিয়মিত। ধারদেনা করে পুরাতন রিকশা কিনল একখানা, কিছুদিন চালাল। কিন্তু হঠাৎ দেখা দিল পেটের ব্যথা। অসহ্য যন্ত্রণায় পথের মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল একদিন। পড়ল বিছানায়। ডাক্তারের কাছে যেতে পারেনি। জানতে পারেনি পেটের ব্যথাটা কীজন্য হচ্ছে এবং আসলে রোগটা কী!’

অবশ্য আছিরনের আর সেই অবস্থা নেই। নিজের হাতে ভাগ্য বদলেছেন। দুই মেয়েকে নিয়ে পাটজাত পণ্য তৈরি করেন। তিনি গ্রামের নারীদেরও প্রশিক্ষণ দেন। পায়রাবন্দসহ সাতটি গ্রামের ৬০০ নারীকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করেছেন তিনি। নিজে হয়েছেন স্বাবলম্বী। পাকা বাড়ি করেছেন। আট শতক জমি কিনে ছোট মেয়েকে বাড়ি করে দিয়েছেন। তাঁর স্বামীও সুস্থ আছেন।  

ওই সময়ের ঘটনা তুলে ধরে আছিরন বলেন, ১৯৭৫ সালে তাঁর বিয়ে হয়। ১৯৭৭ সাল থেকে তাঁর স্বামী অসুস্থ। পেটের ব্যথার কারণে কাজ করতে পারেন না। দুই মেয়ে। আছিরন বলেন, ‘৭ বছর বয়সে কোহিনুরকে বিয়ে দিছি। একটা চিন্তা করে বিয়ে দিছি, স্বামী অসুস্থ। বাজারে গিয়ে যে একটা ওষুধ নিয়ে আসবে, সেই মানুষটা আমার নাই। যে জামাইটার সাথে বিয়ে দিছি, সে ছেলেটাও এতিম। ছেলেটা সব সময় আমার কাছে থাকত। ওই অনুভব করি বিয়েটা দিছি, ছেলেটা যখন আছে। আমারও অভাব একটা লোকের। ওই ছেলে যদি কাছে থাকে সুবিধা হবে।’

কোহিনুর মায়ের কাছ থেকে পাটজাতীয় দ্রব্য থেকে পণ্য তৈরি শিখেছেন। তিনি এখন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। সম্প্রতি রংপুরের মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দে

তবে সাত বছরের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর খুব ভয়ে ছিলেন বলে জানান কোহিনুরের বাবা খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তখন আমার ওপর দিয়ে খুব ঝড়-তুফান হয়ে গেছে। মোনাজাত ভাই ডেইলি (রোজ) আসে। এগুলো শোনে আর লেখে। একটা ইতিহাসের বইও (পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদের কথা বলেছেন) বের হয়েছিল। আমি খুব ভয় করছিলাম, আমার জেল হয় কি না, ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি যেহেতু। একটা কারণে আমার কিছু হয় নাই। প্যাটের ব্যথা ছিল, বাঁচি কি মরি তার ঠিক নাই, ওইজন্য।’

তবে আছিরন ও খলিলুর আর কেউ চান না, ১৮ বছরের নিচে মেয়েকে বিয়ে দিতে। আছিরন বলেন, তাঁর ছোট মেয়ে গোলেনুরের বিয়ে দিয়েছেন ১৮ বছর হওয়ার পরে।
মোনাজাতউদ্দিন যখন পায়রাবন্দের শেখর সংবাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করছিলেন ওই সময় তাঁকে সহযোগিতা করেন বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম (দুলাল)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওই সময় পরিবারটি অসহায় ছিল। এখন ওই অবস্থা বদলে গেছে। পায়রাবন্দেও নারীশিক্ষা এগিয়ে গেছে। এখন আর শিশু বিবাহের প্রচলন নেই। তবে এসব চিত্র তুলে ধরে চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মরণীয় হয়ে আছেন।