জেলার রাজনীতি

‘ঘাঁটি’ নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ আত্মগোপনে, বিএনপিতে প্রার্থী জট-বিভক্তি

প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত শিল্প ও বাণিজ্য নগরী নারায়ণগঞ্জে সংসদীয় আসন পাঁচটি। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ জেলায় গত ১৫ বছরে বিএনপির নেতা–কর্মীরা মামলা-হামলার কারণে চাপে ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁরা আবার মাঠে সক্রিয় হয়েছেন। তবে দখলবাজি, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, মনোনয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভক্তি এখন বিএনপির বড় সংকট। পাঁচটি আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্তত ২৮ জন। জামায়াতে ইসলামী সব কটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সম্ভাব্য প্রার্থীরা তিনটি আসনে তৎপরতা চালাচ্ছে।

এ ছাড়া জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গণসংযোগ চালাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক মাঠ যখন গরম, তখন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা পুরোপুরি আত্মগোপনে।

নির্বাচন কমিশন নারায়ণগঞ্জ ৩, ৪ ও ৫ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। ৩ ও ৫ আসনের সীমানা পরিবর্তন নিয়ে আপত্তি আছে। সীমানা পরিবর্তন হলে তিনটি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের হিসাব-নিকাশও পাল্টে যেতে পারে।

নারায়ণগঞ্জ-১

রাজধানীর পাশের এই আসন রূপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত। এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী পাঁচজন। এর মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া, নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুকসহ পাঁচজন। এখানে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিরোধ প্রকট।

মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব। আর আমার চাইতে ভালো কাউকে মনোনয়ন দিলে তাঁর জন্য কাজ করব।’ আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী কাজী মনিরুজ্জামান বলেন, ‘২০০৮ ও ২০১৮ সালে দলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। আশা করছি দল এবারও মনোনয়ন দেবে।’

জামায়াতে ইসলামীর উপজেলা মজলিসের শুরা সদস্য ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন মোল্লা গণসংযোগ করছেন।

নারায়ণগঞ্জ-২

আড়াইহাজার উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে আছেন বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম, বিএনপির তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান ও কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। এ আসনে আধিপত্য বিস্তার ও মনোনয়নের প্রত্যাশায় বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত।

নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি ২০১৮ সালে দলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছেন। দল তাঁর কর্মকাণ্ড সর্ম্পকে সবকিছু জানে। তিনি আশা করছেন এবারও মনোনয়ন পাবেন।

আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টি জানিয়ে আতাউর রহমান বলেন, ‘সৎ ও পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দল এবারও আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে বিশ্বাস করি।’

এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী জেলার কর্মপরিষদ সদস্য ইলিয়াছ মোল্লা। তিনি নির্বাচন সামনে রেখে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।

নারায়ণগঞ্জ-৩

প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁ এ আসনে পড়েছে। এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাতজন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম, নির্বাহী কমিটির সদস্য মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, আজহারুল ইসলামসহ সাতজন। রেজাউল ও আজহারুলের মধ্যে প্রকাশ্যে বিভক্তি আছে।

রেজাউল করিম বলেন, তিনি চারবার সংসদ সদস্য ও একবার প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। মানুষের জন্য কাজ করেছেন। এবারও মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী।

আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী আজহারুল ইসলাম বলেন, অনেকে বসন্তের কোকিলের মতো এসে প্রার্থী হতে চান। ভাগ্যে থাকলে তিনি মনোনয়ন পাবেন। আর দল অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে তাঁর পক্ষে কাজ করবেন।

মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, নারায়ণগঞ্জ ৩ ও ৪ আসনে মনোনয়নের প্রত্যাশায় কাজ করছেন তিনি। মূল্যায়ন করে দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে বলে আশা তাঁর।

এখানে জামায়াতের প্রার্থী সোনারগাঁ আইডিয়াল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া।

নারায়ণগঞ্জ-৪

জেলার ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা নিয়ে এ আসন গঠিত। এটি আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের আসন। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে। আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরাও গা ঢাকা দিয়েছেন। এ আসনে ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ছিলেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শিল্পপতি মোহাম্মদ শাহ আলম। তিনি এবারও মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ ছাড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মামুন মাহমুদ, সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম, জাসাস কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি মিজান খন্দকারসহ অন্তত সাতজন মনোনয়নপ্রত্যাশী।

মোহাম্মদ শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, দল চাঁদাবাজ ও অপকর্মকারীদের মনোনয়ন না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তিনি আশা করছেন, দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে।

জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে প্রচারণায় সক্রিয় আছেন নারায়ণগঞ্জ মহানগরের আমির আব্দুল জব্বার।

নারায়ণগঞ্জ-৫

শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের এ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সেলিম ওসমান। তিনি শামীম ওসমানের বড় ভাই। তিনি এখন আত্মগোপনে।

এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও তিনবারের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম, মডেল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদুজ্জামান, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেনসহ ছয়জন।

আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত দিনে আমার কর্মকাণ্ড ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতির কারণে আশা করছি দল এবারও আমাকে মনোনয়ন দেবে।’ আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী মোহাম্মমদ মাসুদুজ্জামান আশা করছেন, দল তাঁকে মনোনয়ন দেবে।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাঈনুদ্দিন আহমেদ ইতিমধ্যে গণসংযোগ শুরু করেছেন।

জোরালো তৎপরতা নেই এনসিপির

বড় রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি তিনটি আসনে সক্রিয়। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে যুব শক্তির কেন্দ্রীয় সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব তুহিন মাহমুদ, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ্ আল আমিন, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নির্বাহী আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আহমেদুর রহমান ও দলের দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক শওকত আলী মাঠে আছেন।

আব্দুল্লাহ্ আল আমিন বলেন, দলের সাংগঠনিক কাজে বেশি মনোযোগী হওয়ায় এখনো সব আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি। তিনটি আসনে তিনিসহ সম্ভাব্য প্রার্থীরা কাজ করছেন। নতুন দল হিসেবে জনগণের কাছে পৌঁছাতে একটু সময় লাগছে।