ঝিনাইদহে গুলিতে নিহত রাইসুল ইসলাম। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামে
ঝিনাইদহে গুলিতে নিহত রাইসুল ইসলাম। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামে

ঝিনাইদহে গুলিতে নিহত ৩

বিকেলে ফোন পেয়ে বাড়ি থেকে বের হন রাইসুল, রাতে পাওয়া যায় লাশ

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় গতকাল শুক্রবার রাতে যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের একজন রাইসুল ইসলাম (২৮)। বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আবদালপুর ইউনিয়নের পিয়ারপুর গ্রামে। বাড়ি থেকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলের দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার।

রাইসুলের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, রাইসুল কোনো সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। কেন, কী কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে, তা বলতে পারছেন না। তবে সম্প্রতি এলাকার কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে টাকা লেনদেন নিয়ে বিরোধ চলছিল তাঁর।

গতকাল রাত ১১টার দিকে শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর মাঠের মধ্যে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের হানিফ আলী, তাঁর শ্যালক লিটন হোসেন ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের রাইসুল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যার বিষয়ে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালুর নাম দিয়ে দায় স্বীকার করে গণমাধ্যমকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠানো হয়।

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল রাতে এই এলাকায় তাঁরা একাধিক গুলির শব্দ শুনতে পান। পরে তাঁরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ইবি থানার পিয়ারপুর ও শৈলকুপায় রামচন্দ্রপুর গ্রামের মাঠের মধ্যে শ্মশানঘাট এলাকায় তিনজনকে গুলি করে হত্যার পর ফেলে রাখা হয়েছে। তাঁরা এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান তিনজনের মৃতদেহ পড়ে আছে। পাশে তাঁদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল পড়ে আছে।

রাইসুলের জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী বাবার নাম আরজেদ আলী ও মায়ের নাম রেহেনা পারভিন। ঠিকানা সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রাম। তবে তাঁর বাবার বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার মানিকদিয়াড় গ্রামে। মাত্র আড়াই বছর বয়স থেকে পিয়ারপুর গ্রামে নানা ইব্রাহীম সরদারের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে চলে আসেন। সেখানে তাঁর বাবাও থাকতেন। দুই মাস আগে তিনি মারা গেছেন।

আজ দুপুর ১২টার দিকে পিয়ারপুর গ্রামে রাইসুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা-নানিসহ স্বজনেরা আহাজারি করছেন। প্রতিবেশীরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নানা ইব্রাহীম হোসেন নির্বাক হয়ে বসে আছেন। পাশে বসে কেঁদেই যাচ্ছেন নানি কদ ভানু।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রাইসুলের মা রেহেনা পারভিন জানান, গতকাল বিকেল পর্যন্ত রাইসুল বাড়িতেই ছিলেন। বিকেল পাঁচটার কিছু সময় পর তাঁর মুঠোফোনে কল আসে। রাইসুল ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তির উদ্দেশে বলেন, ‘বড় ভাই আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’ এই বলে মোটরসাইকেল নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে যান তিনি। এরপর রাত নয়টার দিকে কল দিলে নম্বর বন্ধ পান।

গুলিতে নিহত রাইসুল ইসলামের নানি কেঁদেই যাচ্ছিলেন। শনিবার দুপুর ১২টার দিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামের বাড়িতে

রেহেনা পারভিন আরও বলেন, এর পর থেকে আরও কয়েকবার কল দিলেও রাইসুলের নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এ সময় আত্মীয়স্বজনদের কাছে ফোন করে বিষয়টি জানান তিনি। রাত সাড়ে তিনটার দিকে জানতে পারেন, বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে রামচন্দ্রপুর এলাকার মাঠের মধ্যে তাঁর ছেলের লাশ পড়ে আছে।

রেহেনা পারভিন বলে, তাঁর একমাত্র ছেলে রাইসুল। রাইসুলের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন তাঁর স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। এরপর বাবার বাড়িতে এসে থাকা শুরু করেন। গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা করিয়ে ছেলেকে ঝিনাইদহ কে সি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক পড়ান। এরপর কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করান। বাড়িতেই থাকতেন ছেলে। কোনো চাকরি বা ব্যবসা করতেন না। সম্প্রতি দৌলতপুর থেকে তাঁর বাবার সম্পত্তি বিক্রি করে ৯ লাখ টাকা পান। সেই টাকার মধ্যে ৭ লাখ টাকা স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিকে দেন। সেই টাকা ফেরত নিয়ে কিছু ঝামেলা চলছিল।

নিহত রাইসুলের খালাতো বোন সালমা সামাদ একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘রাইসুলকে আমি ছাড়া ভালো কেউ চেনে না বা জানে না। ওর সব আমি জানি। সবকিছু আমার সঙ্গে শেয়ার করত। কিন্তু তাকে হত্যা করা হবে, এটা মানতে পারছি না। সে কোনো সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। তবে এলাকার কিছু খারাপ প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে টাকা দেওয়া ও ফেরত নেওয়া নিয়ে ঝামেলা চলছিল।’

রাইসুলের ছোটবেলার বন্ধু স্থানীয় বাসিন্দা সামি আহমেদ ওরফে সবুজ বলেন, রাইসুল ছোটবেলা থেকে ফুটবল ও ক্রিকেটে খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। একনামে তাঁকে এলাকার মানুষ চেনেন। পড়াশোনায়ও ভালো ছিল। একই কথা বললেন আরেক বন্ধু ফিরোজ হোসেন।

রাইসুল ইসলামের বিষয়ে জানতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি যশোরে একটা মিটিংয়ে আছেন। রাইসুল সম্পর্কে ঝিনাইদহ পুলিশ বা কুষ্টিয়া পুলিশ কেউ কোন কিছু জানতে চায়নি। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন। রাত দশটার পর জানাতে পারবেন।

জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) একজন ওসি বলেন, ‘রাইসুল বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কিছু পেলে জানাচ্ছি।’

এসবি সূত্র বলছে, রাইসুলের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনো মামলা বা অভিযোগ নেই।