
শরীয়তপুর-জাজিরা-নাওডোবা (পদ্মা সেতু অ্যাপ্রোচ) সড়কের নির্মাণকাজ চলছে। তবে ওই সড়কের একটি অংশের জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা একটি চক্রকে সহায়তা করে অবৈধভাবে নির্মিত স্থাপনাগুলোর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ওই এলাকার অবৈধ স্থাপনা শনাক্ত করে সেগুলোকে ‘জনস্বার্থবিরোধী’ হিসেবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছিল প্রশাসন। সেই স্থাপনাগুলোর মূল্য নির্ধারণের জন্য সম্প্রতি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদুল আলম গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগের তালিকা পাঠিয়েছেন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) আশঙ্কা, এই স্থাপনাগুলোর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলে প্রকল্পে অতিরিক্ত ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
সওজের একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, স্থাপনার ক্ষতিপূরণের একটি ইস্যু দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এখন তা নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাতে কিছু নতুন স্থাপনা যুক্ত করা হয়েছে। যার জন্য অতিরিক্ত ৮ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
সওজ ও জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার তথ্য বলছে, পদ্মা সেতু হয়ে শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে ঢাকায় যাতায়াত সহজ করতে ২০২০ সালে ২৭ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। ভূমি অধিগ্রহণ ও সড়ক নির্মাণ মিলিয়ে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। ২০২০ সালে জমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। সদর, নড়িয়া ও জাজিরা এলাকায় ২২টি ভূমি অধিগ্রহণসংক্রান্ত মামলার (এলএ কেস) মাধ্যমে প্রায় ২৬০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া এগোয়। ওই সময় জমিতে কী কী স্থাপনা আছে, তা নিশ্চিত হতে ভিডিও চিত্র ধারণ করে জেলা প্রশাসন।
৫ বছরে ২২টির মধ্যে ১৬টি এলএ কেসের জমি সওজকে হস্তান্তর করা হয়। তিনটি প্যাকেজে সড়ক নির্মাণ এগোচ্ছে। শহর থেকে জাজিরা কলেজ পর্যন্ত সাড়ে ১৩ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে সাড়ে ১১ কিলোমিটারের কাজ শেষ। কিন্তু জাজিরার ঢালীকান্দি ও মতিসাগর এলাকায় ২ কিলোমিটার এলাকার কাজ বন্ধ। কারণ, ১৬ নম্বর এলএ কেসে জমি হস্তান্তর হয়নি।
কেন কাজ হয়নি, তা জানতে গিয়ে নতুন তথ্য পাওয়া গেল। ২০২১ সালে ভূমিমালিকদের ৪ ধারা অনুযায়ী নোটিশ দেওয়া হলে একটি চক্র বেশি ক্ষতিপূরণের আশায় অবৈধভাবে ঘরবাড়ি নির্মাণ শুরু করে।
জেলা প্রশাসন ও সড়ক বিভাগের প্রতিনিধিরা সেখানে যৌথ তদন্ত করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের স্থাপনা-ঘরবাড়ি ও গাছপালার তালিকা করেন। ওই তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের পর ২০২৩ সালে অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তারা অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণের আশায় নির্মাণ করা স্থাপনা বাদ দিয়ে প্রকৃত তালিকা মূল্য নির্ধারণের জন্য গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগে পাঠান। আর বাদ দেওয়া স্থাপনাগুলোকে ‘জনস্বার্থবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
কিন্তু ওই স্থাপনার মালিকেরা ক্ষতিপূরণ চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আপিল করেন। এরপর একটি চক্র অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সেই স্থাপনাগুলো তালিকাভুক্ত করতে সচেষ্ট হয়। সম্প্রতি ওই আবেদনগুলো আমলে নিয়ে ৩৮টি স্থাপনার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নেয় অধিগ্রহণ শাখা।
২০ অক্টোবর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদুল আলম গণপূর্ত বিভাগ ও বন বিভাগকে পুনরায় মূল্য নির্ধারণের তালিকা পাঠিয়েছেন। অভিযোগ হলো, এই নতুন তালিকায় অবৈধ স্থাপনাগুলোকে ঢোকানো হয়েছে।
অধিগ্রহণ শাখা ও সওজের কাছ থেকে ৪ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। সেখানে দেখা যায়, সড়কের পূর্ব পাশে বসতি আর পশ্চিমে নিচু কৃষিজমি। যেখানে ফাঁকা জমি দেখা গেছে, বর্তমানে সেখানে কাঠের ও টিনের ঘর দাঁড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ ঘর তালাবদ্ধ, কেউ বসবাস করে না, মালামালও নেই।
মাঠে গিয়ে দেখা যায়, অনেক ঘর কাঠের পাটাতনের ওপর বসানো। পুরোনো ঘর এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়।
মতিসাগর এলাকার কাজী নজরুল ইসলামের ঘরটি নতুন তালিকায় ‘মুরগির খামার’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু সেখানে কোনো মুরগি নেই। তিনি বলেন, ‘আমি মুরগির খামারি। বাড়ির পাশে নিজেদের জমিতে খামার করেছি। সেই খামারের জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, তাই ক্ষতিপূরণ পাব।’
ঢালীকান্দির চাঁন মিয়া শিকদার ২০ বছর ধরে ঢাকায় থাকেন। গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে তাঁর কোনো ঘর ছিল না। কিন্তু তাঁর জমিতে একটি দালাল চক্র তিনটি ঘর নির্মাণ করে ক্ষতিপূরণের তালিকায় টেনে এনেছে। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাসুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এই এলএ কেসে ৫৯টি আপত্তি পাওয়া যায়, যা নিষ্পত্তি করার জন্য শুনানি গ্রহণ করা হয়। সওজের প্রতিনিধিদের নিয়ে সরেজমিন আরও অধিকতর যাচাই–বাছাই শেষে ৩৯টি আবেদন মঞ্জুর করেছেন তিনি। সেখানে কোনো অনিয়ম বা অসংগতি হয়নি বলে তাঁর দাবি।
জানতে চাইলে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সময় যৌথ তদন্ত করা হয়। তখন যদি কারও কোনো স্থাপনা বাদ পড়ে থাকে, তারা আপত্তি জানিয়ে আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত কমিটি যাচাই-বাছাই করে তা দিয়েছে। যদি আমাদের কাছে প্রমাণ আসে যে সেখানে কোনো স্থাপনা ছিল না, তা হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’