মাদারীপুর

‘পৌরসভার বর্জ্যে’ ভরাট হচ্ছে কুমার নদ, দুর্গন্ধে টেকা দায়

পৌরসভার বর্জ্য ফেলার কারণে কুমার নদের একাংশ ভরাট হয়ে গেছে। সম্প্রতি মাদারীপুর পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের চরমুগরিয়া বন্দরের পাটগলি নৌঘাটে
ছবি: প্রথম আলো

মাদারীপুর কুমার নদের পাড়ে বর্জ্য ফেলার কারণে নদের একটা বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে দূষিত হয়ে পড়েছে নদের পানি। দুর্গন্ধে নদের দুই পাড়ের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন ধরে পৌরসভার ময়লা-আবর্জনা ফেলায় নদ ভরাট ও দূষিত হচ্ছে। এ জন্য সাধারণ মানুষ নয়, খোদ পৌর কর্তৃপক্ষই দায়ী। তবে পৌর কর্তৃপক্ষ সেখানে ময়লা ফেলে না বলে দাবি করেছেন মেয়র।

মাদারীপুর পৌর শহরের বুক চিরে চলে গেছে আড়িয়াল খাঁ নদ। এর শাখা কুমার নদ। এ নদের একটি অংশে চরমুগরিয়া বন্দর। এই বন্দর ঘিরে কয়েকটি অস্থায়ী নৌঘাট রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম পাটগলির শেষ মাথার নৌঘাটটি। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, এ নৌঘাটের পাড়ে দীর্ঘদিন ধরে ফেলা হচ্ছে পৌরসভার বর্জ্য।

পাটগলি নৌঘাট এলাকার ব্যবসায়ী আসাদ শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নৌঘাট একসময় আড্ডার জায়গা ছিল। দুর্গন্ধের কারণে এখন আর কেউ আসেন না। আমরা যারা এই এলাকায় ব্যবসা করি, তাদের বাধ্য হয়ে দুর্গন্ধ সহ্য করতে হচ্ছে। পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ময়লা ফেলতে নিষেধ করার পরও তারা কারও কথা শোনে না।’

এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্জ্যের স্ত‍ূপ জমে থাকায় সারাক্ষণ বাতাসে দুর্গন্ধ ভেসে বেড়ায়। দুপুর ও বিকেলে দুর্গন্ধে ঘরে টেকা যায় না। রোজ আমাদের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ময়লা ফেলার বিকল্প জায়গা নেই। পৌর কর্তৃপক্ষ নদের পাড়ে ময়লা ফেলতে বলেছে। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। আমাদের নিষেধ করে লাভ নাই, স্যারদের বলেন।’

ময়লা-আবর্জনা ফেলার বিষয়টি জানেন বলে মন্তব্য করেছেন পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার প্রধান ও পৌরসভার আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা হরষিত বিশ্বাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভ্যানচালকেরা যে নদে বর্জ্য ফেলেন, তা আমাদের জানা ছিল না। বর্জ্য শুকনা জায়গায় ফেলার কথা। নদের পাড়ে ফেলার কথা নয়। এটি অবশ্যই নিয়মের বাইরে।’ বর্জ্য ফেলা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, চলতি বছরের মধ্যে পৌরসভার নিজস্ব ভাগাড় ও ডাম্পিং স্টেশন করা হবে। তখন আর পৌরসভার বর্জ্য নিয়ে কোনো সমস্যা থাকবে না।

তবে মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র খালিদ হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুমার নদে পৌর কর্তৃপক্ষ ময়লা ফেলে না। স্থানীয় লোকজন হয়তো ফেলে থাকতে পারে। ওখানে যে ময়লা ফেলা হচ্ছে, সেটা আমিও দেখেছি। নদে যাতে ময়লা না ফেলা হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’

পানিপ্রবাহ কম থাকায় বর্জ্যের স্তূপ জমে কুমার নদের অনেকখানি ভরাট হয়ে গেছে। মাদারীপুর পৌরসভার চরমুগরিয়া বন্দরের পাটগলি নৌঘাটে

গতকাল বৃহস্পতিবার কুমার নদ–তীরবর্তী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পৌরসভার ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা এবং চরমুগরিয়া কাঁচাবাজারের সব ময়লা-আবর্জনা পৌরসভার ভ্যানগাড়িতে কুমার নদের পাড়ে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে চরমুগরিয়া বন্দরের ৬ থেকে ৭টি ক্লিনিকের বর্জ্য। পানিপ্রবাহ কম থাকায় বর্জ্যের স্তূপ জমে নদের অনেকখানি ভরাট হয়ে গেছে। নদজুড়ে পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে বর্জ্য। এর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

৮ নম্বর ওয়ার্ডের কুমরাখালি এলাকার বাসিন্দা মাসুদ সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্দরের সব ময়লা-আবর্জনা বহুদিন ধরে নদে ফেলা হচ্ছে। এখন আর নদে গোসল করার পরিবেশ নাই। ময়লা ভাসতে থাকায় নদের পানি আগের মতো ব্যবহার করা যায় না। আমাদের চোখের সামনে নদটা দখল-দূষণে মরে যাচ্ছে। এগুলো কি দেখার কেউ নাই?’

দুই বছর আগেও কুমার নদে প্রতিদিন গোসল করতেন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যখাগদী এলাকার কলেজছাত্র বাঁধন মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন নদে মরা গরু, মরা মুরগি ভাসতে দেখা যায়। বাজারের সব ময়লা-আর্বজনা ভেসে আসে আমাদের ঘাটে। এ কারণে গোসল করা যায় না।’

কুমার নদের পানিদূষণের কারণে এখন আর আগের মতো মাছ শিকার করতে পারছেন না স্থানীয় জেলেরা। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কুমরাখালি এলাকার জেলে বিমল মালো প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদ আর আগের মতো নাই। দখলে দুই পাশই সরু হয়ে গেছে। নদে জাল ফেললে প্লাস্টিক আর ময়লা ওঠে। ছোট ছোট কিছু মাছ পাওয়া গেলেও বড় মাছ আর পাওয়া যায় না। আমাগো (জেলেদের) খুব কষ্টের দিন যাইতাছে।’

মাদারীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ইয়াকুব খান প্রথম আলোকে বলেন, পৌরসভা দায়িত্ব হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং নাগরিকদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ করা। অথচ পৌরসভার সরাসরি ইন্ধনে নদটি দূষিত ও ভরাট হচ্ছে। পৌর কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে না। নদটি দূষণের হাত থেকে রক্ষায় তাদের দায়িত্ব নিতে হবে।