সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল জলাবন নৌকা নিয়ে ঘুরে দেখছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। বুধবার দুপুরে
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল জলাবন নৌকা নিয়ে ঘুরে দেখছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। বুধবার দুপুরে

রাতারগুল রক্ষায় একজোট গ্রামবাসী

মাসখানেক আগের ঘটনা। তিন ব্যক্তি দেশের মিঠাপানির একমাত্র জলাবন রাতারগুলের ভেতরে অবৈধভাবে বালু তোলা শুরু করেন। খবর পেয়ে রাতারগুল গ্রামের লোকজন ছুটে যান। বালু লুটকারীদের হাতেনাতে আটক করে তাঁরা বন কর্মকর্তাদের কাছে সোপর্দ করেন। বালু ছাড়াও মাছ, গাছ, পাখি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এভাবেই এককাট্টা রাতারগুল গ্রামের বাসিন্দারা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর যেখানে সর্বদলীয় ‘ঐক্যমতে’ বালু-পাথর লুটের কারণে সিলেটের অধিকাংশ পর্যটনকেন্দ্র শ্রীহীন হয়ে পড়েছে, এর উল্টো চিত্র দেখা গেল রাতারগুলে। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় এখানে তৈরি হয়েছে গণ–ঐক্য।

সিলেট নগরের কদমতলী বাস টার্মিনাল থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে গোয়াইনঘাট উপজেলায় রাতারগুলের অবস্থান। জলাবন (সোয়াম্প ফরেস্ট) হওয়ায় এটিকে বন বিভাগ ১৯৭৩ সালে সংরক্ষিত ঘোষণা করে। ৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের বনটি হাওর ও নদীবেষ্টিত।

রাতারগুলের পরিস্থিতি যেন তেমন না হয়, সেখান থেকে কেউ গাছ না কাটেন কিংবা মাছ না ধরেন, সেটা ঐক্যবদ্ধভাবে ঠেকানোর পরিকল্পনা নেন রাতারগুলবাসী।

জলাবন হওয়ায় রাতারগুলের মূল কর্তৃপক্ষ বন বিভাগ। তবে পর্যটকদের আনাগোনার কারণে উপজেলা প্রশাসন এ বনটিকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখে। সাধারণত বর্ষাকালেই রাতারগুল অনিন্দ্যসৌন্দর্য মেলে ধরে। বেড়াতে যাওয়া মানুষ নৌকায় করে বনে ঘুরে বেড়ান।

এক বছর ধরে সিলেটের প্রায় সব কটি পর্যটনকেন্দ্রে থাকা পাথর আর বালু দেদার লুট হয়। এতে জেলার সাদাপাথর, সংরক্ষিত বাংকার এলাকা, জাফলং, উৎমাছড়া, বিছনাকান্দি, শ্রীপুর, রাংপানি, লালাখাল, লোভাছড়ার সৌন্দর্য ম্লান হয়ে পড়ে। বিএনপি, জামায়াত ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক এসব স্থানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘ঐকমত্যের’ ভিত্তিতেই লুটপাট চালান।

রাতারগুলের পরিস্থিতি যেন তেমন না হয়, সেখান থেকে কেউ গাছ না কাটেন কিংবা মাছ না ধরেন, সেটা ঐক্যবদ্ধভাবে ঠেকানোর পরিকল্পনা নেন রাতারগুলবাসী। সে অনুযায়ী বনে গ্রামবাসীর নিজস্ব উদ্যোগে পাহারা বসে। পাশাপাশি রাতারগুল এবং এর সংলগ্ন সারি-গোয়াইন (স্থানীয়ভাবে চেঙ্গেরখাল নামেও পরিচিত) নদে কেউ যেন বালু তুলে বনের ক্ষতি করতে না পারে, সে নজরদারিও শুরু হয়। এ ছাড়া বনে থাকা বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি যেন কেউ শিকার না করেন, সেটাও গ্রামবাসী দেখভাল করেন।

নিজেদের এলাকার সম্পদ নিজেদের রক্ষা করতে হবে। তাই গ্রামের সব বাসিন্দা ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ-বিদেশে সুপরিচিত রাতারগুলের সৌন্দর্য রক্ষায় কাজ করেন। সবাই বনটিকে নিজের মনে করেন। তাই কোনো ধরনের অপশক্তি এখানে সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রের মতো অপকর্ম করতে পারেনি।
সোনা মিয়া, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্য

রাতারগুলের প্রকৃতি ও পরিবেশ অক্ষত রাখার ফল গ্রামবাসী এখন হাতেনাতে পাচ্ছেন। জাফলং, সাদাপাথরসহ অন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে যখন পর্যটকের খরা চলছে, তখন গাছ-জলের অপূর্ব সমন্বয় আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে রাতারগুলে ভিড় করছেন পর্যটকেরা। গতকাল শনিবারও হাজারো পর্যটককে নৌকা দিয়ে বনের ভেতরে ঘুরতে দেখা গেছে। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় রাতারগুলও পূর্ণ যৌবনের পসরা মেলে ধরেছে।

ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্য সোনা মিয়ার বাড়ি রাতারগুল গ্রামে। তিনি বললেন, ‘নিজেদের এলাকার সম্পদ নিজেদের রক্ষা করতে হবে। তাই গ্রামের সব বাসিন্দা ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ-বিদেশে সুপরিচিত রাতারগুলের সৌন্দর্য রক্ষায় কাজ করেন। সবাই বনটিকে নিজের মনে করেন। তাই কোনো ধরনের অপশক্তি এখানে সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রের মতো অপকর্ম করতে পারেনি।’

জলাবনের ঘাটের পাড়ে বসে গল্প জমে কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, বনের সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গ্রামবাসী ঐক্যবদ্ধ থাকায় অবৈধ বালু উত্তোলনকারী, মাছ-পাখিশিকারি কিংবা গাছ লুটপাটকারীরা এখানে লুটপাট করার সাহস পায়নি। এক দশক আগে ‘একটি সিন্ডিকেটের’ বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তারা আর এখন অপকর্মে তেমন সক্রিয় নয়।

হিজল-করচের রাতারগুলের দৃশ্য

রাতারগুল সমাজকল্যাণ পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ। তাঁর সংগঠনটি জলাবনে বেড়াতে আসা ব্যক্তিদের ফেলা দেওয়া চিপসের প্যাকেট, পানির বোতলসহ বর্জ্য অপসারণে প্রতি বুধবার পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি চালায়। শাকিল বলেন, ‘শুধু জলাবন অক্ষত রাখা নয়, এর পরিবেশ ও সৌন্দর্য রক্ষায়ও স্থানীয় লোকজন নিয়মিত কাজ করেন।’

গ্রামের বাসিন্দাদের মুখে অনেক কিছুই জানা হয়ে যায়। তাঁরাই জানালেন, রাতারগুলে নৌকার মালিক-মাঝি, পর্যটনকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গ্রামের বয়স্ক, যুবক ও তরুণ সবাই অনেক আগে থেকেই বনটিকে গভীরভাবে আগলে রাখেন। তবে এক বছর ধরে অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রের গণলুটের বিষয়টি মাথায় রেখে স্থানীয় লোকজন এ বনটিকে আরও আগলে রেখেছেন। বনকেন্দ্রিক অপতৎপরতা কেউ চালানোর চেষ্টা করলে সবাই সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করেন।

রাতারগুলকে ঐক্যবদ্ধভাবে আগলে রাখার বিষয়টি ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় বলে মন্তব্য করেছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী। তিনি বলেন, ‘অনেকে যখন বালু, পাথর লুটপাটে ব্যস্ত, রাতারগুলের মানুষ তখন সরকারি সম্পদ রক্ষার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এমন উদ্যোগ দৃষ্টান্ত হোক।’

  • সুমনকুমার দাশ, গোয়াইনঘাট, সিলেট থেকে ফিরে