মেলায় স্টল নিয়ে নিজের কারুপণ্য বিক্রি করেন সৌরভ মণ্ডল
মেলায় স্টল নিয়ে নিজের কারুপণ্য বিক্রি করেন সৌরভ মণ্ডল

সৌরভ শুরু করেছিলেন দুই হাজার টাকায়, এখন মাসে লাখ টাকার পণ্য বেচেন

সৌরভ মণ্ডল (২৭) যখন দশম শ্রেণির ছাত্র, তখন ধরা পড়ে, জন্মগতভাবে তাঁর খাদ্যনালিতে ত্রুটি আছে। দেশে ও ভারতে চিকিৎসা করিয়ে বেঁচে থাকলেও পড়ালেখা ছাড়তে হয়। ব্যাংক কর্মকর্তা বড় ভাই তাঁকে দুই হাজার টাকা দেন। সেই টাকা দিয়েই নিজের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন সৌরভ। এখন তাঁর তৈরি কারুপণ্য অনলাইনের মাধ্যমে দেশে–বিদেশে বিক্রি হয়।

সৌরভ মণ্ডল নেত্রকোনা সদর উপজেলার নাগড়া বাড়ইপাড়া গ্রামের মনোরঞ্জন মণ্ডল ও রিতা রানী মণ্ডলের সন্তান। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। বড় ভাই তন্ময় মণ্ডল একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহ নগরের আর কে মিশন রোডের একটি বাসায় থাকেন।

আফ্রিকান পুতুল বানিয়ে পরিচিতি

পরিবার সূত্রে জানা যায়, অসুস্থতার কারণে ২০১২ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায় সৌরভের। দেখা দেয় মেরুদণ্ডের সমস্যাও। পরের বছর থেকে তিনি ময়মনসিংহ শহরে তাঁর এক আত্মীয়ের দোকানে বসতেন। সেখানে কাজের ফাঁকে কাগজ ও ক্লে দিয়ে নিজের ঘরের জন্য তৈরি করতেন পুতুল। ২০১৯ সালে ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে দেশে ফেরার পর চিকিৎসক বিশ্রামের পরাদর্শ দেন সৌরভকে। বাসায় বসে সময় কাটানো সৌরভকে তাঁর বড় ভাই কারুপণ্য বানাতে দুই হাজার টাকা দেন। শুরুতে ১২টি আফ্রিকান পুতুল বানান। একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দেওয়ার পর ক্রেতারা বেশ আগ্রহ দেখান। একের পর এক পুতুলের জন্য অর্ডার আসতে থাকে।

সৌরভ কারুপণ্য তৈরির কারখানা দিয়েছেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার দাপুনিয়া চান্দেরবাজার সড়কে। সেখানে পাঁচ হাজার টাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে পাট দিয়ে নানা কারুপণ্য তৈরি শুরু করেন। সম্প্রতি তাঁর কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, পাট, কাগজের কার্টন, গ্লু স্টিক ও ফেভিকল ব্যবহার করে নানা কারুপণ্য তৈরি করছেন পাঁচ নারী শ্রমিক। সেখানে তৈরি হচ্ছে পুতুল, ফুলদানি, কলমদানি, টিস্যু বক্স, ওয়ালমেট, পাটের সিকা ও দেয়াল সাজানোর নানা উপকরণ।

সৌরভের কারখানায় কাজ করেন নয়জন নারী

ওই কারখানায় কাজ করেন স্থানীয় এক নারী ফারজানা ইয়াসমিন। তিনি জানান, এখানে এক বছর ধরে কাজ করেন। মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় হয়। এতে সন্তানদের হাতখরচ দিতে পারেন তিনি।

আরেক নারী ঝুমা আক্তারের স্বামী পল্লিচিকিৎসক। সংসারে স্বামীর পাশাপাশি নিজে সহযোগিতা করতে প্রায় দুই বছর ধরে সৌরভের কারখানায় কাজ করছেন। বাড়তি আয়ে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে বলে জানান তিনি।

সৌরভ বানিয়েছেন ১৫০ ধরনের পণ্য

উদ্যোক্তা সৌরভ মণ্ডল বলেন, ‘১২টি পুতুল তৈরি করে ফেসবুকে পোস্ট করার পর আমি ৭ হাজার টাকার অর্ডার পাই। শুরুতেই মানুষের কাছে আমার তৈরি পণ্য ভালো লাগায় আমার কাজে আগ্রহ বাড়ে। এরপর নানা কিছু তৈরি করে বিক্রি করতে থাকি। কিন্তু রঙে আমার অ্যালার্জি থাকায় ২০২২ সাল থেকে পাট নিয়ে কাজ শুরু করি। এখন পাট দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করছি। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০ ধরনের পণ্য তৈরি করেছি।’

কারুপণ্য বানানোর কাজে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে সৌরভ মণ্ডল বলেন, তিনি এসব কাজ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখেননি। পরিবারের সদস্যদের নানা কাজ দেখে নিজে নিজে শিখেছেন। তাঁর দাদা কাঠের কাজ করতেন, তাঁর বাবা স্টিলের জিনিসপত্র তৈরি করতেন। এসব দেখে তাঁর কিছু তৈরির আগ্রহ শুরু হয়।

সৌরভ মণ্ডল ২০২২ সাল থেকে পাট নিয়ে কাজ শুরু করেন

ঢাকা, ফরিদপুর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে পণ্য তৈরির উপকরণগুলো সংগ্রহ করার কথা জানান সৌরভ মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘আমার তৈরি পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে ও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করা হয়। অনন্যা নামে আমার একটি পেজও আছে। আমি দুই হাজার টাকায় শুরু করলেও বর্তমানে আমার পুঁজি খাটানো আছে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা। প্রতি মাসে লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করি। সব খরচ বাদ দিয়ে মাসে ২০–৩০ হাজার টাকা আয় থাকে। এখন নয়জন নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।’ তাঁর তৈরি পণ্য যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর, কাতারসহ ১২ থেকে ১৩টি দেশে বিক্রি হয়েছে বলে তিনি জানান।

শারীরিক অসুস্থতার কারণ পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলেও সৌরভ নতুন করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে এসএসসি পাস করে এখন ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। তাঁর উদ্যোগ আরও বড় করার স্বপ্ন তাঁর। এ ছাড়া শহরে একটি শোরুম দিতে চান। কারখানাটা বড় করতে চান, যাতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।