চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ষোলশহর রেলস্টেশনের অবস্থান। সেখানে চাকসু নির্বাচনের প্রার্থীরা নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ষোলশহর রেলস্টেশনের অবস্থান। সেখানে চাকসু নির্বাচনের প্রার্থীরা নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন।

চাকসু নির্বাচন: প্রতিশ্রুতিতে ‘ঠাসা’ ছাত্রদল ও শিবিরের ইশতেহার

ক্যাম্পাস সবার জন্য নিরাপদ হবে। উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করতে পারবেন সব শিক্ষার্থী। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়বে ক্যাম্পাসজুড়ে। আবাসন–সংকট দূর হবে। এ রকম নানা প্রতিশ্রুতি উঠে এসেছে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেলের পৃথক ইশতেহারে। গতকাল বুধবার ক্যাম্পাসে ইশতেহার ঘোষণা করে ওই দুই প্যানেল।

বেলা আড়াইটায় ক্যাম্পাসের বুদ্ধিজীবী চত্বরে প্রথমে সংবাদ সম্মেলন করে ইশতেহার ঘোষণা করে ছাত্রশিবির। ৩৩ দফার এ ইশতেহারে ৯টি মূল পয়েন্টের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আবাসন–সংকট নিরসন, নিরাপদ ও সবুজ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা, গবেষণা জোরদার, যাতায়াতব্যবস্থা উন্নত করা, সেশনজট নিরসন, নারীবান্ধব ক্যাম্পাস নির্মাণ, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ, দাপ্তরিক কাজের স্বয়ংক্রিয়করণ (অটোমেশন) এবং কল্যাণমূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা।

অন্যদিকে বেলা সাড়ে তিনটায় একই জায়গায় ইশতেহার ঘোষণা করে ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেল। তাদের ইশতেহারে আটটি দফা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিনোদনমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্যাম্পাস সমৃদ্ধ করা ক্যারিয়ার গঠনে দক্ষতা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা ইত্যাদি।

এই দুই প্যানেলের ইশতেহার নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ ছিল। ফলে গতকাল সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের অনেকেই দুই প্যানেলের ইশতেহার মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ইশতেহারে প্রায় সব সংকটের সমাধান করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক বছরে কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবে, সে প্রশ্ন রয়েছে।

অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাওসিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত কয়েক দিন ধরে অনেক প্রার্থীর ইশতেহার দেখেছি। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ইশতেহার দেখে একই রকম মনে হয়েছে। আমার কাছে ভিন্ন কিছু মনে হয়নি।’

এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সব ইশতেহার একই রকম মনে হচ্ছে। দুই প্যানেলের ইশতেহার দেখে মনে হচ্ছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করতে চায়। তবে মাত্র এক বছরে মধ্যে সব প্রতিশ্রুতি আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না, সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।’

দুই প্যানেলের ইশতেহারেই নারীদের বিষয়ে নানা প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সে প্রসঙ্গে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম বলেন, নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যেন কাগজেই সীমাবদ্ধ না হয়। নির্বাচিত হয়ে আসা প্রার্থীদের এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।

আর মাত্র পাঁচ দিন পরই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ১৫ অক্টোবর নির্বাচন হচ্ছে। এবার প্রার্থী হয়েছেন ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী। প্যানেল হয়েছে ১৩টি।

গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস চায় ছাত্রদল

প্যানেলের এজিএস পদপ্রার্থী আইয়ুবুর রহমানের সঞ্চালনায় ইশতেহার পাঠ করেন ভিপি পদপ্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, একটি উদার গণতান্ত্রিক ও নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এ ইশতেহার তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাঁরা সংকট বোঝার চেষ্টা করেছেন। এর ভিত্তিতে ইশতেহারে আটটি দফা যুক্ত করা হয়েছে।

ইশতেহারে শিক্ষা ও গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল নির্বাচিত হলে অনলাইন স্টুডেন্ট পোর্টাল চালু করা হবে। এর মাধ্যমে ক্লাস রুটিন, ফলাফলের তথ্য জানাসহ একাডেমিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে। এ ছাড়া ম্যাটল্যাব স্থাপন এবং গবেষণার প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারকে আধুনিকায়ন করে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখা, প্রতিটি হলে পাঠকক্ষ ও গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা এবং শহরের ২ নম্বর গেটে গ্রন্থাগারের শাখা করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ইশতেহারে বলা হয়, সেশনজট নিরসন, ওপেন ক্রেডিট ও ক্রেডিট ট্রান্সফারের ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রশাসনিক জটিলতা কমাতে ‘লাঞ্চের পরে আসেন’ সংস্কৃতি দূর করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ভাতা বৃদ্ধি, হলে আসন সংরক্ষণ, ব্রেইল বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

১২ মাসে ৩৩ সংস্কারের ঘোষণা

নির্বাচিত হলে ১২ মাসে ৩৩টি সংস্কার করতে চায় ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’। ইশতেহার পাঠ করে প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মো. ইব্রাহীম হোসেন বলেন, ‘ইশতেহারের সব বিষয় এক বছরে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, তবে আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমরা কাজ করব।’

ইশতেহারে বলা হয়, নির্বাচিত হলে প্রথমেই আবাসন–সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিদ্যমান হলগুলো সংস্কার, এক্সটেনশন ব্লক বৃদ্ধি ও নতুন টিনশেড নির্মাণের মাধ্যমে হলে অন্তত ১০ শতাংশ আসন বৃদ্ধি করার জন্য প্রশাসনকে বাধ্য করা হবে। পাশাপাশি হলের আবাসন বণ্টনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে।

হলে খাবারের মান যাচাইয়ের স্কেল প্রবর্তন, ক্যাফেটেরিয়া সংস্কার এবং হোটেল-বাজার তদারক করে মান ও মূল্য নির্ধারণের পরিকল্পনাও রয়েছে ইশতেহারে। একাডেমিক জটিলতা নিরসনে সেশনজট দূরীকরণ ও ডিজিটাল একাডেমিক ক্যালেন্ডার বাস্তবায়নের উদ্যোগ ঘোষণা করা হয়। প্রতিটি বিভাগে সময়মতো পরীক্ষা, ফলাফল প্রকাশ, রেজিস্ট্রেশন ডিজিটাল ব্যবস্থায় সম্পন্ন করার অঙ্গীকার করা হয়।

ইশতেহারে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সুবিধার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মাতৃত্বকালীন ছুটি, নারীদের কমনরুমে শিশুর যত্ন কেন্দ্র (চাইল্ড কেয়ার কর্নার), ব্রেস্টফিডের জোন স্থাপন এবং ক্যাম্পাসে নারীবান্ধব অবকাঠামো তৈরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

দুই দলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

এদিকে গতকাল ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী মো. ইব্রাহীম হোসেনের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে ছাত্রদল। বেলা পৌনে দুইটায় নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।

ছাত্রদলের অভিযোগ, ভিপি প্রার্থী মো. ইব্রাহীম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ভবনে (নতুন কলাভবন) গিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রচারণা চালিয়েছেন। শ্রেণিকক্ষের সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে প্রায় ২০ মিনিট ধরে ইতিহাস বিভাগের ৩২৩ নম্বর কক্ষে প্রচারণা চালানো হয়। এতে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। কেননা শ্রেণিকক্ষে গিয়ে প্রচারণা চালানোর সুযোগ নেই। সাউন্ড সিস্টেমও ব্যবহার করা যাবে না।

এ ঘটনার পর সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের কাছে গিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টা অভিযোগ দেন শিবির–সমর্থিত প্যানেলের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী মেহেদী হাসান সোহান।

অভিযোগে বলা হয়, গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে আইন অনুষদের প্রথম বর্ষের ক্লাস চলাকালে ছাত্রদলের কর্মী ও আইন বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী নাঈম উদ্দিন ক্লাসে প্রবেশ করে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। এ সময় তিনি ছাত্রদল–সমর্থিত প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী সাজ্জাদ হোসেনের পক্ষে প্রচারমূলক বক্তব্য দেন, প্রচারপত্র বিতরণ করেন এবং অন্যান্য প্যানেলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক ও উত্তেজনাকর মন্তব্য করেন।

অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক এ কে এম আরিফুল হক সিদ্দিকী বলেন, দুই পক্ষের অভিযোগের বিষয়ে আচরণবিধি তদারক কমিটির প্রধান অধ্যাপক আমির মুহাম্মদ নসরুল্লাহকে জানানো হয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।