
খুলনা নগরের প্রধান সড়ক ও ফুটপাত এখন পথচারীদের নয়, হকারদের দখলে। ডাকবাংলা থেকে বড়বাজার পর্যন্ত নগরের প্রধান ব্যবসাকেন্দ্রজুড়ে ফুটপাতের ওপর চলছে অস্থায়ী দোকানপাট, পণ্যের পসরা আর ক্রেতাদের ভিড়। ফলে পথচারীদের হাঁটার জায়গা নেই, স্থায়ী দোকানের ব্যবসায়ীরা হারাচ্ছেন ক্রেতা, হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত।
ডাকবাংলা এলাকা খুলনা নগরের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র। এখানে ডাকবাংলা সুপারমার্কেট, রেলওয়ে মার্কেট, খুলনা বিপণিবিতান, দরবেশ চেম্বার, শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিপণিবিতান, কাজী নজরুল ইসলাম মার্কেট, মশিউর রহমান মার্কেটসহ বড় শপিং কমপ্লেক্স আছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের অন্যতম বাজার এটি। কিন্তু এখন এর পুরো এলাকার ফুটপাত দখল হয়ে গেছে ভাসমান ব্যবসায়ীদের হাতে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, ডাকবাংলা মোড় থেকে ক্লে রোড পর্যন্ত ফুটপাতে মালামাল সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। স্থায়ী দোকানদাররাও নিজেদের দোকানের সামনের জায়গা দখল করে ব্যবসা করছেন। ভ্যানে করে জামাকাপড়, ফল, গৃহস্থালির পণ্য বিক্রি হচ্ছে ফুটপাতের পর এখন রাস্তার অর্ধেকজুড়ে। পুরোনো যশোর রোড, সদর থানা মোড়, কেডি ঘোষ রোড থেকে হেলাতলা পর্যন্ত একই চিত্র। খালিশপুর চিত্রালি বাজার ও দৌলতপুর বাজারেও ফুটপাতের ওপর খাট বসিয়ে চালা তুলে ব্যবসা চলছে। ফলে পথচারীদের চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রতিদিন।
খালিশপুর চিত্রালি বাজারের দোকান ব্যবস্থাপক মো. আসাদ বলেন, ‘হকারদের কারণে বাইরে থেকে আমাদের দোকান দেখা যায় না। তাদের ব্যবসা জমজমাট, কিন্তু আমাদের বিক্রি কমে গেছে। সিসিটিভি ক্যামেরাগুলোও ঢেকে গেছে অস্থায়ী দোকানে।’
খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) সূত্রে জানা গেছে, নগরের আয়তন ৪৬ বর্গকিলোমিটার, পাকা সড়ক ৬৪১ কিলোমিটার। ফুটপাতের সঠিক হিসাব না থাকলেও অন্তত ২৫ কিলোমিটার ফুটপাত হকারদের দখলে। চলতি বছরে ১২ দিনের মতো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই ফের দখল হয়ে যায়।
কেসিসির সম্পত্তিবিষয়ক কর্মকর্তা গাজী সালাউদ্দীন বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী নেতা ও প্রশাসন সবাই একসঙ্গে উদ্যোগ না নিলে এটি বন্ধ হবে না। অনেকে নিজের দোকানের সামনের ফুটপাতও ভাড়া দেন হকারদের। সহযোগিতা না পেলে একা আমাদের কিছু করার নেই।’
ফুটপাত দখলের পেছনে আছে এক চক্র। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খুলনার এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘একবার কেউ বসিয়ে দেওয়ার পর দোকানদাররা তাঁদের আর উঠাতে পারেন না। ক্ষতি পোষাতে সামনের দোকানগুলোর মালিক তাঁদের সামনে হকার বসতে দেওয়ার বিনিময়ে প্রতিদিন টাকা নেন। করপোরেশন থেকে পাঁচ টাকার একটা টোকেন দেয়, তখন হকাররা বলে—করপোরেশন আমাদের বসিয়েছে। এতে এখন একেবারে হযবরল অবস্থা।’
কথা হয় আটজন হকারের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, পুলিশ বা সিটি করপোরেশন অভিযান চালালে তাঁরা অন্যত্র চলে যান, পরে আবার ফিরে আসেন। কেউ কেউ বলেন, সামনের দোকানদারদের তাঁরা প্রতিদিন একটি বড় অঙ্কের টাকা দেন। এক ব্যবসায়ী নেতা বলেন, হকারদের বসানোর সিন্ডিকেট এখন রাজনৈতিক দলের হাতে নেই, বরং নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ অপরাধীরা। কিছু ঘটলেই তাদের লোকজন মুহূর্তে হাজির হয়।
খুলনা বিপণিকেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক এবং খুলনা শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘শহরের মূল ব্যবসাকেন্দ্র ক্লে রোড পুরোপুরি দখলে। অদৃশ্য একটা লেনদেন আছে। এত ভিড় যে মহিলারা শপিং করতে পারেন না, নিয়মিত টাকা-মোবাইল হারায়। আমরা কর, ভ্যাট, ভাড়া দিই, অথচ হকাররা প্রতিদিন তিন হাজার টাকার মতো আয় করে, আমাদের বিক্রি হয় না। করপোরেশন আর পুলিশ একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপায়, আমরা কার কাছে যাব।’
খুলনা শপিং কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি এস আনামুল হোসেন বলেন, হকারদের কারণে শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ীরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। সামনে হাঁটার জায়গা নেই। হকারদের পুনর্বাসন করে বা অন্যভাবে স্থায়ী সমাধান জরুরি।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (ট্রাফিক) ছয়রুদ্দীন আহম্মদ বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই, কিন্তু আবারও তারা বসে যায়। স্থায়ী সমাধানের উপায় নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভাবছে।’