জলাশয় থেকে কয়েকটি মৃত হাঁস তোলার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন চেরাগ আলী। আজ শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে
জলাশয় থেকে কয়েকটি মৃত হাঁস তোলার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন চেরাগ আলী। আজ শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে

‘বিষ খাওয়াইয়া হাঁসগুলা মারিয়া আমারে পথে বসাই দিল’

সবে সকাল হয়েছে। বাড়ির পাশের জলমগ্ন জমিতে এদিক-ওদিকে ভাসছিল মৃত হাঁস। খামারি চেরাগ আলী ও তাঁর স্বজনেরা পানিতে নেমে সেই মৃত হাঁসগুলো তুলে জমির আলে জমা করছিলেন। একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন চেরাগ আলী। তিনি বলেন, ‘এই হাঁসগুলাই আমার সম্বল আছিল। কত যত্ন করি এইগুলারে পালছি। বিষ খাওয়াইয়া হাঁসগুলা মারিয়া আমারে পথে বসাই দিল। আমি নিঃস্ব হই গেলাম।’ তাঁর কান্নায় পাশে থাকা কয়েকজন প্রতিবেশীরও চোখ ভিজে ওঠে।

চেরাগ আলীর (৬৫) বাড়ি মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে। প্রায় ১৪ বছর ধরে তিনি হাঁস পালন করছেন। তাঁর খামারে দেশি প্রজাতির ৫০০ হাঁস ছিল—কিছু ডিম দিত আর কিছু অচিরেই ডিম পাড়া শুরু করার কথা ছিল। জলমগ্ন জমিতে খাবার খেতে নেমে গতকাল মারা গেছে ৩৩৫টি হাঁস।

আজ শুক্রবার সকালে গোবিন্দপুরে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের পাশে নিচু কয়েকটি জমিতে পানি আটকানো আছে। স্থানীয়ভাবে জলমগ্ন সেই স্থান ‘গোবিন্দপুরের জাওর’ নামে পরিচিত।

চেরাগ আলী জানান, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার সকালে তিনি হাঁসগুলো ওই স্থানে ছেড়ে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজে দূরের জমিতে চলে যান। বিকেলে এসে দেখেন, অনেক হাঁস মৃত অবস্থায় ভাসছে। জমির আলে ছড়ানো-ছিটানো ধান দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। দ্রুত জীবিত হাঁসগুলো বাড়িতে নিয়ে আসেন। আলো কমে যাওয়ায় মৃতগুলো তুলতে পারেননি। বাড়িতে নেওয়ার পর আরও চার-পাঁচটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিনি জানান, তেঁতুলের রস খাইয়ে সেগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। তাঁর ধারণা, জলমগ্ন স্থানের আশপাশে ছড়ানো বিষ মেশানো ধান খেয়েই হাঁসগুলো মারা গেছে।

চেরাগ আলী আরও বলেন, ‘প্রায় ১৪ বছর ধরি হাঁস পালি। ডিম বেচিয়া সংসার চালাই। পাঁচ মাস আগে কিশোরগঞ্জ থাকি ৪০০ বাচ্চা কিনি আনি বড় করি তুলছিলাম। কিছুদিন পরেই এইগুলা ডিম পাড়া শুরু করি দিত। সব মরিয়া শেষ হই গেল।’

চেরাগ আলী জানান, জলমগ্ন স্থানটিতে এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির জমি আছে। বর্ষায় জমিগুলো দীর্ঘ সময় পানিতে তলিয়ে থাকে এবং মাছের আবাসস্থল হয়। শুষ্ক মৌসুমে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখে সেই জলাশয় মাছ ধরার জন্য ইজারা দেওয়া হয়। এবার পশ্চিম গোবিন্দপুরের মফিজ আলীসহ কয়েকজন এটি ইজারা নিয়েছেন। মাছ ধরা শেষ হলে বোরো ধানের মৌসুমে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়।

খামারি চেরাগ আলী ও তাঁর স্বজনেরা পানিতে নেমে সেই মৃত হাঁসগুলো তুলে জমির আলে জমা করছিলেন। আজ শুক্রবার সকালে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে

চেরাগ আলীর দাবি, জলাশয়ের ধারে ছড়ানো বিষ মেশানো ধান খেয়েই তাঁর হাঁসগুলো মারা গেছে। কে বা কারা তা ছিটিয়েছে, তিনি দেখেননি। এতে তাঁর লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ঘটনায় তিনি জুড়ী থানায় লিখিত অভিযোগ করবেন।

প্রতিবেশী ফয়জুর রহমান, আবদুস সামাদসহ আরও কয়েকজন বলেন, শীতের শুরুতে হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন জলাশয়ে পরিযায়ী পাখির ভিড় থাকে। তখন দুর্বৃত্তরা বিষটোপ বা জাল পেতে পাখি শিকার করে। তবে গোবিন্দপুরের জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় এ এলাকায় পাখি সাধারণত আসে না। তাঁদের ধারণা, পাখি নয়, হাঁস নিধনের উদ্দেশ্যেই এখানে বিষ ছড়ানো হয়েছে। তাঁরা ঘটনাটিকে অমানবিক উল্লেখ করে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে শাস্তির দাবি জানান।

‘গোবিন্দপুর জাওর’-এর ইজারাদার মফিজ আলী মুঠোফোনে বলেন, এ ঘটনা সম্পর্কে তাঁদের কিছু জানা নেই। কয়েক দিন ধরে তাঁরা অন্য একটি বিলে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত।

জুড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মুরশেদুল আলম ভূঁইয়া বলেন, খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।