গত মঙ্গলবার কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকত এলাকায় সাগরে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হন তিনজন। পরে সাদমান আর পরদিন আসিফের লাশ সৈকতে ভেসে এলেও অরিত্র এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। সমুদ্রসৈকতে তাঁর অপেক্ষায় রয়েছেন স্বজনেরা।
পাঁচতলার এক কোণে ছোট একটি কক্ষ। ওপরে লেখা—৫০৮। বাইরে ঝুলছে তালা। ভেতরে উঁকি দিতেই চোখে পড়ে—এলোমেলো বিছানা, টেবিলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বই। দরজার পাশে পড়ে রয়েছে কয়েক জোড়া স্যান্ডেল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মো. ফরহাদ হোসেন হলের এই কক্ষেই থাকতেন কক্সবাজারে সাগরে ডুবে মারা যাওয়া দুই শিক্ষার্থী আসিফ আহমেদ ও সাদমান রহমান এবং নিখোঁজ অরিত্র হাসান।
গত মঙ্গলবার কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকত এলাকায় সাগরে গোসল করতে নেমে নিখোঁজ হন তিনজন। পরে সাদমান আর পরদিন আসিফের লাশ সৈকতে ভেসে এলেও অরিত্র এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। সমুদ্রসৈকতে তাঁর অপেক্ষায় রয়েছেন স্বজনেরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার শহীদ ফরহাদ হোসেন হলে গিয়ে দেখা হয় তিনজনের সেই কক্ষটি। এ সময় কথা হয় হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রিয়াদ মিয়ার সঙ্গে। আরবি বিভাগের প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থীও আসিফদের সঙ্গে কক্সবাজার গিয়েছিলেন। রিয়াদ মিয়া বলেন, ‘হলটিতে সাদমান, আসিফ ও অরিত্র একসঙ্গে থাকত। তিনজনই একই বিভাগের বিভাগের। ফলে ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব ছিল অনেক বেশি। পড়ালেখার পাশাপাশি এই কক্ষেই সারাক্ষণ আড্ডায় মেতে থাকত তিনজন’।
এই কক্ষটি ছিল আমাদের ছোট একটি জগৎ। মাঝরাত পর্যন্ত ওই কক্ষে আড্ডা দিতাম। খুনসুটি, খোশগল্প, সিনেমা, পড়ালেখা সবকিছু নিয়েই আমাদের আড্ডা হতো। এখন তারা হলে নেই। সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।রিয়াদ মিয়া, আবাসিক শিক্ষার্থী, শহীদ মো. ফরহাদ হোসেন হল
নিজেও ওই কক্ষে আড্ডা দিতেন জানিয়ে রিয়াদ বলেন, ‘আমি হলের ১০৪ নম্বর কক্ষে থাকি। তবু দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত ৫০৮ নম্বর কক্ষে।এই কক্ষটি ছিল আমাদের ছোট একটি জগৎ। মাঝরাত পর্যন্ত ওই কক্ষে আড্ডা দিতাম। খুনসুটি, খোশগল্প, সিনেমা, পড়ালেখা সবকিছু নিয়েই আমাদের আড্ডা হতো। এখন তারা হলে নেই। সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে’।
রিয়াদ জানান, চলতি মাসের ১ তারিখে আড্ডার এক ফাঁকে বান্দরবান যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তাঁরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী গত মঙ্গলবার আসিফ, সাদমান, অরিত্র এবং আরেক বন্ধু ফারহানকে নিয়ে দুপুরে ক্যাম্পাস থেকে রওনা হয়েছিলেন। তবে মাঝপথে সিদ্ধান্ত বদলে বান্দরবান থেকে কক্সবাজার যান। রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁরা কক্সবাজার পৌঁছান।
সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণা করে রিয়াদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের রাতে বৃষ্টিতে ভেজার কারণে আমার জ্বর হয়েছিল। তাই পরের দিন সকালে সবাই সাগরের পানিতে নামলেও, জ্বরের কারণে আমি নামিনি। ফারহান মুঠোফোন জমা রাখতে পানি থেকে ওপরে উঠে। এর মধ্যেই হঠাৎ ঢেউয়ের তোড়ে বাকি তিনজন ভেসে যায়’।
হলের নিরাপত্তাপ্রহরী সৌরভ সরকার এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না ৫০৮ নম্বর কক্ষের তিন শিক্ষার্থী নেই। তিনি বলেন, ‘তিনজন সব সময় একসঙ্গে যাওয়া-আসা করত। কক্সবাজার যাওয়ার আগে আমি বলেছিলাম এখন বিপদসংকেত চলছে, যেও না। অরিত্র হেসে বলেছিল—মামা, পানিতে নামব না।’
শহীদ মো. ফরহাদ হোসেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘তিনজনই ভদ্র ও মেধাবী ছাত্র ছিল। হলের সবাই শোকাহত। ৫০৮ নম্বর কক্ষের এই শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র-ডায়েরি ও আসবাবসহ সবকিছু তালিকাভুক্ত করে ৫০৮ নম্বর কক্ষ সিলগালা করে রাখা হয়েছে। অভিভাবকেরা এলে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।’
সাগরে নেমে নিখোঁজ দুজনের লাশ সৈকতে ভেসে এলেও অরিত্রের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন তাঁর বাবা সাকিব হাসান। গতকাল বৃহস্পতিবার এক ভিডিও বার্তায় তিনি ছেলে নিখোঁজের পেছনে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন। সাকিব হাসান বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় বাবা। প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষে করে একটি ছেলে কয়েকজন বন্ধু নিয়ে বেড়াতে এসেছে, রিসোর্টে উঠেছে। রিসোর্টের কি দায়িত্ব নয় লাইফ জ্যাকেট দেওয়া? সৈকত যদি বিপজ্জনক হয় সেটাকে বিপজ্জনক ঘোষণা করে লাল পতাকা উড়িয়ে নিরাপত্তাপ্রহরী রাখা কি উচিত নয়?’