ফগার মেশিন তৈরির কারখানায় মাছুম বিল্লাহ মজুমদার। গত সোমবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কনকাপৈত গ্রামে
ফগার মেশিন তৈরির কারখানায় মাছুম বিল্লাহ মজুমদার। গত সোমবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কনকাপৈত গ্রামে

চাকরি ছেড়ে কারখানা স্থাপন, মশা মারার ফগার মেশিন তৈরি করছেন মাছুম

নারায়ণগঞ্জে চাকরি করতেন মাছুম বিল্লাহ মজুমদার। ভাড়া বাসায় মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ছিলেন। তিনি পড়ালেখা করেছেন কারিগরি বিষয়ে। তাই নিজেই মশা নিধনের ফগার মেশিন তৈরির চেষ্টা শুরু করেন তিনি। এই কাজে প্রথম দিকে তিনি ব্যর্থ হন। অবশেষে তিনি ফগার মেশিন তৈরিতে সফল হন।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের কনকাপৈত গ্রামে মাছুম বিল্লাহের (৩৩) বাড়ি। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চাকরি ছেড়েছেন তিনি; নিজ গ্রামে ফগার মেশিন তৈরির কারখানা স্থাপন করেছেন। প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন ‘এম এইচ আই আলট্রা পাওয়ার মিনি ফগার মেশিন ফ্যাক্টরি’। ফগার মেশিনে ব্যবহৃত গ্যাসের বোতল ও রাসায়নিক ছাড়া অন্য সব যন্ত্রাংশই তৈরি হচ্ছে ওই কারখানায়। প্রতিটির দাম সাড়ে ছয় হাজার টাকা। ইতিমধ্যে তিনি প্রায় আড়াই শ ফগার মেশিন বিক্রি করেছেন।

মাছুম বিল্লাহ মজুমদার কনকাপৈত গ্রামের প্রয়াত আবদুল হক মজুমদারের ছেলে। চার ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। মাছুম ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া শেষ করেন। পরে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগে বিএসসি পাস করেছেন। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার।

সরেজমিনে দেখা যায়, কনকাপৈত গ্রামে মাছুম বিল্লাহর বাড়ির সামনে একটি টিনশেড ঘরে ফগার মেশিন তৈরির কারখানা। বর্তমানে কাজ করেন দুজন শ্রমিক। প্রতিদিন এখানে একটি ফগার মেশিন তৈরি করা সম্ভব হয় হচ্ছে। প্রতিটি মেশিন বিক্রি করা হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ টাকায়। পরীক্ষামূলকভাবে সরাসরি ছাড়াও অনলাইনে এই মেশিন বিক্রি করা হয়।

মাছুম বিল্লাহ মজুমদার জানান, প্রতিবারে দুই লিটার রাসায়নিক এবং ২৫০ গ্রামের একটি বিউটেন গ্যাসের বোতল ব্যবহার করে তাঁর ওই মিনি ফগার মেশিনটি দিয়ে ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট জায়গায় মশক নিধনের স্প্রে করা যাবে। তাঁর প্রতিটি মেশিনের বডি এসএস স্টিল ও লেজার কাটিংয়ে তৈরি। তবে তিনি এখনো মেশিনটি বাজারজাত করার অনুমোদন নেননি। শিগগিরই মেশিনটি পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পাঠাবেন।

এই ফগার মেশিনে কম খরচে অনেক বেশি জায়গা স্প্রে করা যাবে। মেশিনটি অনেক বেশি মজবুত; সহজে নষ্ট হবে না। এসএস স্টিল দিয়ে তৈরি লেজার কাটিং মেশিনটি মাত্র ৬ হাজার ৫০০ টাকা হলেই বিক্রি করছি।
মাছুম বিল্লাহ মজুমদার, উদ্যোক্তা

গল্পে গল্পে ফগার মেশিন তৈরির কথা শোনান মাছুম বিল্লাহ। তিনি বলেন, ‘২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জে মেডিকেল পণ্য তৈরির একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম। বেতন পেতাম ৫০ হাজার টাকার বেশি। তখন যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সেখানে ছিল প্রচুর মশা। এত পরিমাণ মশা যে বলে শেষ করা যাবে না। বাড়ির মালিককে বললাম, মশা মারার একটি মেশিন কিনে আনার জন্য। কিন্তু তিনি বাজারে গিয়ে চায়না পণ্য এবং দাম বেশি হওয়ায় মেশিন না কিনেই ফিরে আসেন। এরপর মনে হলো আমি যেহেতু কারিগরিতে পড়াশোনা করেছি, নিজেই চেষ্টা করে দেখি কম খরচে ভালো ফগার মেশিন তৈরি করতে পারি কি না। সেই থেকেই চেষ্টা শুরু। প্রথমে চেষ্টা করার সময় কয়েকবার আগুনও ধরে গিয়েছিল। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে প্রায় দুই বছর চেষ্টার পর মেশিনটি তৈরি করতে পেরেছি।’

নিজের তৈরি ফগার মেশিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মাছুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমার এই ফগার মেশিনে কম খরচে অনেক বেশি জায়গা স্প্রে করা যাবে। মেশিনটি অনেক বেশি মজবুত; সহজে নষ্ট হবে না। এসএস স্টিল দিয়ে তৈরি লেজার কাটিং মেশিনটি মাত্র ৬ হাজার ৫০০ টাকা হলেই বিক্রি করছি। অথচ বাজারে প্লাস্টিকের বডি চায়না পণ্য কোরিয়ান বলে বিক্রি করা হচ্ছে ১২–১৫ হাজার টাকায়। এই হিসাবে আমাদের মেশিনটির দাম ২০ হাজার টাকা হওয়ার কথা।’

এসএস স্টিল দিয়ে তৈরি লেজার কাটিং ফগার মেশিনটির দাম ৬ হাজার ৫০০ টাকা

সামনে উদ্যোক্তা হতে চান বলে জানিয়ে মাছুম বলেন, ‘প্রায় ৬ মাস আগে বাড়ির সামনে ছোট পরিসরে এই কারখানা করেছি। এর আগ থেকেই অনলাইনে মেশিনটি পরীক্ষামূলক বিক্রি করেছি। গত মাসে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। সামনে বড় একটি কারখানা করতে চাই। যেখানে কর্মসংস্থান হবে এলাকার বেকার যুবকদের। মেশিনটি আস্তে আস্তে সারা দেশে ছড়িতে দেওয়ার ইচ্ছা আছে। শিগগিরই বুয়েটে যন্ত্রটির পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় অনুমোদন নেব।’

উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মীর হোসেন মীরু বলেন, ‘আমাদের এলাকার ছেলে মাছুম বিল্লাহ মশা মারার মেশিন তৈরি করছেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তিনি পড়াশোনা করে বড় চাকরি করতেন, সেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বড় উদ্যোক্তা হওয়ার আশায়। তাঁর তৈরি করা মেশিনটি আধুনিক মানের। আশা করছি সারা দেশে তাঁর আবিষ্কার করা মেশিন ছড়িয়ে যাবে। আমিও তাঁকে সফলতা উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চাই।’

চৌদ্দগ্রাম উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে খোঁজখবর নেব। ওই যুবক যদি আমাদের কোনো সহায়তা চান, তাহলে আমরা চেষ্টা করব তাঁকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে। তাঁর তৈরি মেশিনটি প্রয়োজনে আমরাও ব্যবহার করে দেখব। এভাবে যুবকেরা উদ্যোক্তা হলে এলাকায় বেকারত্ব কমে আসবে।’