পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা বাসন্তী গড়ের সঙ্গে শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্দ্বী পাঁচ সন্তান। গত সোমবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কালিটি চা-বাগানে
পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা বাসন্তী গড়ের সঙ্গে শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্দ্বী পাঁচ সন্তান। গত সোমবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কালিটি চা-বাগানে

‘ভগবান ৫টা সন্তান দিল, তারার মুখে কথা দিল না, কথা শোনার শক্তি দিল না’

আট সদস্যের পরিবার। মা, বাবা, চার ছেলে আর দুই মেয়ে। ভাই-বোনদের মধ্যে একজন বাদে বাকি সবাই শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী। পাঁচ সন্তানের এমন অবস্থা নিয়ে আক্ষেপ আর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই তাদের বাবা রামজনম গড়ের (৭০)। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গড় (৫৫) পক্ষাঘাতগ্রস্ত। রামজনম নিজেও বয়সের ভারে চা-বাগানে কাজে যেতে পারেন না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বিশাল সদস্যের সংসারটি চলে বড় ছেলে হীরা গড়ের (২২) সামান্য উপার্জনে।

সোমবার বিকেলের দিকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কালিটি চা-বাগানের ৮ নম্বর লাইনে মাটির দেয়ালঘেরা ঘরের উঠানে বসে কথা হচ্ছিল রামজনমের সঙ্গে। আট সদস্যের পরিবারটি ছোট এ ঘরে গাদাগাদি করে বসবাস করে।

ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রামজনম বলে ওঠেন, ‘শরীরটাতে আগের মতো শক্তি পাই না, বাবু। কামকাজ করতে পারি না। সম্পদ বলতে দুইটা গরু আছে। এইগুলারে নিয়াই দিন চলি যায়, সকালে ঘাস খাওয়াইতে নিয়া যাই; আবার বিকেলে ঘরে নিয়া ফিরি। কাজ বলতে এইটুকুই করি।’

রামজনমের ছয় সন্তানের মধ্যে একমাত্র সুমিত্রা গড় সুস্থ। কয়েক বছর আগে পাশের কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই চা-বাগানে তাঁকে বিয়ে দেন। বাকি পাঁচ সন্তানই জন্মের পর থেকে শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী। এই চার ছেলের মধ্যে হীরা গড় বড়। এরপর কানাইলাল গড় ও কৃষ্ণলাল গড় যমজ এবং সবার ছোট দীপক গড়। মেয়েদের মধ্যে লক্ষ্মী গড়েরও প্রতিবন্ধিতা আছে।

শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী পাঁচজনসহ ছয় সন্তানকে এই মাটির দেয়ালঘেরা ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন রামজনম ও বাসন্তী গড় দম্পতি

রামজনম বলেন, তাঁর অবসরের পর ছেলে হীরা বাগানে কাজ পান। সেখানে তিনি দৈনিক মজুরি পান ১৭০ টাকা। সঙ্গে রেশনের কিছু আটা মেলে। হীরার কাঁধেই পুরো সংসারের ভার পড়েছে।

রামজনমের স্ত্রী বাসন্তীর চিকিৎসা করালেও পুরোপুরি সেরে ওঠেননি। এখনো ডান হাতে শক্তি পান না। হাত থরথর করে কাঁপে। সংসারের সব কাজ সামাল দিতে পারেন না। তাঁকে সাহায্য করেন ছেলে-মেয়েরাই। সেই ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়েই যত দুর্ভাবনা তাঁর। রামজনম বলেন, ‘ভগবান পাঁচটা সন্তান দিল, তারার মুখে কথা দিল না, কথা শোনার শক্তি দিল না। আমরা আর কয় দিন বাঁচি! তারার (পাঁচ সন্তানের) জীবনটা কীভাবে যাইব, এইটাই শুধু ভাবি।’

ছেলে-মেয়েরা প্রতিবন্ধী ভাতা পায় কি না, জানতে চাইলে রামজনম বলেন, একমাত্র কৃষ্ণলাল কয়েক বছর ধরে প্রতি মাসে ৮৫০ টাকা ভাতা পাচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকার কয়েকজনের পরামর্শে সম্প্রতি অন্য সন্তানদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে পাঠান। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাকি চারজনকে প্রতিবন্ধী উল্লেখ করে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। এখন প্রত্যয়নপত্র নিয়ে উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে ভাতার জন্য আবেদন করবেন।

কুলাউড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা প্রাণেশ বর্মা জানান, রামজনমের প্রতিবন্ধী পাঁচ সন্তানের সবার ভাতার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আর সিলেটের শ্রবণ ও বাক্‌প্রতিবন্ধী আবাসিক বিদ্যালয়ে ৬-৯ বছর বয়সী শিশুদের ভর্তি করা হয়। রামজনমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট দীপক গড়ের সেখানে ভর্তির সুযোগ আছে। এ বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।