
সময়টা শনিবার দুপুর। কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামের নোয়াগাঁও গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠে ২২ জন ধাওয়াল সবুজ রঙের জার্সি গায়ে বোরো ধান কাটছিলেন। তাঁদের কেউ আঁটি বেঁধে মাথায় তুলে দিচ্ছিলেন, কেউ সেগুলো মাথায় নিয়ে কৃষকের বাড়ির উঠানে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। কড়া রোদে শরীরে বেশ ঘাম হচ্ছিল। তবে এর মধ্যেই কারও কারও কণ্ঠে ঝরছিল গানের সুর।
সোনালি ধানের সঙ্গে রঙিন জার্সি—এ দুইয়ে মিলে হাওরের ফসলি মাঠে এক অন্য রকম সৌন্দর্য। ২২ সদস্যের দলটির প্রধান ছাহের উদ্দিন। রঙিন জার্সি গায়ে ধান কাটার কারণ জানান ছাহের। তিনি বলেন, ‘হাওরে ফসল হয় বছরে একবার। বোরো ধান। এরপর সারা বছর অপেক্ষা। ধান কাটা শুরু মানে একটা মাস ভালা থাকা। এবার ভালা ধান হইছে। ভালা ধান হইলে কৃষক খুশি। আবার আমরারও লাভ। শুধু কৃষক আনন্দ করব ক্যান? কষ্টের কাজেও মনে আনন্দ ধইরা রাখার লাইগা জার্সি কিনছি, নিজেদের টেহায়।’
ধান কাটা দলের সদস্যরা মনে করেন তাঁদের পরিহিত জার্সি সবাইকে জোটবদ্ধ রাখার প্রতীক। এটি মনে যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি পরস্পরের সম্পর্ককেও মজবুত করে। সদস্য অলি আহমেদ বললেন, ‘ভাই ভাই সম্পর্ক বানায় এই জার্সি।’
কিশোরগঞ্জের হাওরে এবার বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার হেক্টরপ্রতি অন্তত ১০ মণ ধান বেশি হচ্ছে বলে ধারণা কৃষি বিভাগের। অষ্টগ্রামের সব হাওরের হিসাব একই। চিটা হয়নি। এখন পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়েছে। ধান ৮০ ভাগ পাকা হয়ে গেলে কেটে ফেলার কৃষি বিভাগের পরামর্শের পর কাটায় গতি এসেছে। এই অবস্থায় যেদিকে চোখ যায়, কেবল সোনালি ধানের শিষ দোল খাওয়ার দৃশ্য।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে হাওরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৪৩০ হেক্টর। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬৮ টন। যার আনুমানিক বাজারমূল্য চার হাজার কোটি টাকা। চালের লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ টন। অষ্টগ্রামে লক্ষ্যমাত্রা ২৪ হাজার ১৬০ হেক্টরের চেয়ে বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়।
বেলা পৌনে তিনটার দিকে অষ্টগ্রামের উসমানপুর হাওরের নদীঘাটে লাল জার্সি পরে একটি ধাওয়াল দল দুপুরের খাবার খেয়ে নৌকায় বসে খানিকটা বিশ্রাম করছিল। দলের নাম ভাই ভাই গ্রুপ। দলের প্রধান রেনু মিয়া। হাওরের ধাওয়ালজীবন নিয়ে কথা হয় তাঁদের সঙ্গে। ভাই ভাই গ্রুপ নাম রাখার কারণ জানালেন তাঁরা। জানা গেল, অষ্টগ্রামে হিন্দু–মুসলমানের বসতি অনেক পুরোনো। ১৮ সদস্যের দলে অর্ধেকের বেশি মুসলমান, বাকি সদস্যরা হিন্দু। হিন্দু-মুসলমান মিলে ভাই ভাইয়ের সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করেন বলে দলের নাম ভাই ভাই গ্রুপ।
দলের প্রধান রেনু মিয়া বলেন, ‘ধান কাটার কাজে তিন সপ্তাহের মতো ভোর থাইক্কা হাইঞ্জা (সন্ধ্যা) পর্যন্ত একলগে থাহুম। জমি থাইক্কা কৃষকের বাড়ির দূরত্ব বুঝে এক খের জমি চার হাজার থাইক্কা সাড়ে চার হাজার টেহার বিনিময়ে ধান কাটি। দিনে গড়ে বারো শ থাইক্কা দেড় হাজার টেহা কইরা বাড়ি লইয়া যাইতে পারি।’ প্রসঙ্গত, খের স্থানীয় ভাষা। ১ খের মানে ২৫ শতাংশ জমি।
পুরো বিষয় নিয়ে কথা হয় অষ্টগ্রাম উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অভিজিৎ সরকারের সঙ্গে। ধান কাটার সার্বিক বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত তিনি সন্তুষ্ট। প্রথম আলোকে অভিজিৎ সরকার বলেন, ফলন হেক্টরপ্রতি ১০ থেকে ১২ মণ বেশি হচ্ছে। দামও মন্দ নয়। সব মিলিয়ে ভালো করে মাঠের ফলন গোলায় তুলতে পারলে এই খুশি মহাখুশির মাত্রা পাবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপপরিচালক মো. সাদিকুর রহমান ভালো ফলনের খুশি ধরে রাখতে ধান ৮০ ভাগ পাকা মাত্র কেটে ফেলার আহ্বান জানান। কারণ, ঝড় কিংবা শিলাবৃষ্টি হাওরের পাকা ধানে মই দেওয়ার আশঙ্কা সব সময় থেকেই যায়।