
১৫ বছর আগে স্বামী আমজাদ হোসেন মারা যান। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তিন শিশুসন্তানকে (এক ছেলে ও দুই মেয়ে) নিয়ে বিপদে পড়েন বুলবুলি বেগম। বাধ্য হয়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু ওই আয় দিয়ে সংসার চলছিল না। পরে এলাকার একটি খাবার হোটেলে বাবুর্চির কাজ নেন। মজুরি কম দেওয়া হলেও সংসার চালাতে দীর্ঘদিন কাজটি করে যান বুলবুলি।
করোনা মহামারি শুরু হলে হোটেলের কাজ হারান বুলবুলি বেগম। এতে করে আরও বেকায়দায় পড়েন সংগ্রামী এই নারী। একপর্যায়ে নিজে কিছু একটা করার চিন্তা মাথায় আসে তাঁর। দীর্ঘ সময় হোটেলে রান্না করার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রংপুর মহানগরের প্রেসক্লাবের কাছে চপ, পেঁয়াজু, পুরি, বেগুনি, বুট, বুন্দিয়া ও চা বিক্রি শুরু করেন।
শুরুতে বেগ পেতে হলেও এখন জমজমাট বিক্রি বুলবুলি বেগমের দোকানে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত তাঁর দোকানের চা–চপ খেতে ভিড় করেন মানুষজন।
রংপুর প্রেসক্লাব মার্কেটে ভোর হতেই শুরু হয় হকার–এজেন্টদের ব্যস্ততা। মঙ্গলবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কেউ ঢাকা থেকে আসা গাড়ি থেকে পত্রিকা নামাচ্ছেন, কেউ গুনছেন, কেউ তা বাইসাইকেলের পেছনে বেঁধে নিয়ে ছুটছেন পাঠকের দুয়ারে। এই সব ব্যস্ততা বুলবুলি বেগমের মচমচে চপ, পেঁয়াজু, পুরির বিক্রিও বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কাজের ফাঁকে, কেউবা কাজ শেষে সকালের নাশতা হিসেবে তাঁর দোকানে এসব খেয়ে থাকেন।
পত্রিকার এজেন্ট তানভীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সীমার মায়ের (বুলবুলির) চা–চপ না খেলে দিনটাই ভালো কাটে না। একজন নারী হয়েও আপা যেভাবে সংসারের হাল ধরেছেন, তা অতুলনীয়।
প্রতিদিন বুলবুলি বেগমের হাতে তৈরি খাবারে সকালের নাশতা করেন হকার স্বপন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সীমার মা অনেক মেহনত করেন। আমরা কমবেশি তাঁর দোকানেই খাবার খাওয়ার চেষ্টা করি। বলা চলে, তাঁর সঙ্গেই দিন শুরু, তাঁর সঙ্গেই দিনের শেষ হয় এখানকার অনেকের।’
প্রেসক্লাব মার্কেটের সামনের সড়কের পাশে বুলবুলি বেগমের দোকান। প্রায় পাঁচ হাত লম্বা, তিন হাত প্রস্থের একচালা দোকানটির সামনে ব্যস্ততম সড়ক, পেছনে ভবন। বুলবুলি একদিকে চুলা রেখেছেন, অন্যদিকে কাচ দিয়ে ঘেরা কাঠের একটি টেবিল। কড়াইয়ে ভাজার পর পেঁয়াজু, চপ, বেগুনি, বুট, বুন্দিয়া ও পুরি কাচঘেরা অংশে রাখছেন। খাবারে যাতে ময়লা বা মশা-মাছি বসতে না পারে, এ জন্য এই ব্যবস্থা।
মহানগরের মীরবাগে বাবার বাড়ি বুলবুলি বেগমের। তবে তিনি ভাড়া থাকেন নগরীর আদর্শপাড়া এলাকায়।
পত্রিকার এজেন্ট-হকারসহ স্থানীয় ব্যক্তিরা বুলবুলি বেগমকে সীমার মা বলে ডাকেন। আশপাশের কারও খাবারের প্রয়োজন হলে দূর থেকে ডাকেন। দ্রুত সেই খাবার পৌঁছেও দেন তিনি।
মঙ্গলবার সকালে দোকানে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন বুলবুলি বেগম। এক ফাঁকে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। বিক্রি ভালো জানিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে কম বিক্রি হলেও এখন দৈনিক দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার বিক্রি হয়। প্রতিদিন খরচ বাদে ৫০০-৬০০ টাকা লাভ থাকে। ব্যবসার টাকায় এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। আরেক মেয়ে পড়ছে অষ্টম শ্রেণিতে। ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন।
ব্যবসা পরিচালনায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না জানিয়ে বুলবুলি বেগম বলেন, ‘দোকান করে নিজের আয়ে সুখে আছি। এখানকার সবাই আমাকে খুব ভালোবাসেন।’