পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত
পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত

চট্টগ্রামে এক দিনের ভ্রমণে যেখানে বেড়াবেন

ঘুরে বেড়াতে সাগর-নদী-পাহাড় সব সময় কাছে টানে পর্যটকদের। এর সবকিছুরই একসঙ্গে দেখা মেলে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম নগর এবং এর আশপাশেই ঘুরে বেড়ানোর মতো এমন অনেক স্থান রয়েছে, যেখানে অনায়াসেই বন্ধুবান্ধব ও পরিবার নিয়ে আনন্দমুখর সময় কাটানো যায়। চট্টগ্রাম নগর ও এর আশপাশে এক দিনে ঘুরে বেড়ানোর মতো কয়েকটি স্থানের বিষয়ে জানা যাক।

পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত

সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। অদূরে নোঙর করে আছে সারি সারি জাহাজ। শীতল হাওয়ায় বসে এসব দৃশ্য উপভোগ করা যায় চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে।

কেবল তীরে বসে সাগর দেখা নয়, চাইলে পা ভেজানোর সুযোগও রয়েছে। দ্রুতগতির নৌযানে (স্পিডবোটে) ঘুরে বেড়ানো যায় উপকূলের কাছে। সমুদ্রসৈকতে ঝিনুক-শামুকের নানা পণ্য বিক্রির দোকান, টগবগিয়ে ঘোড়ার ছুটে চলা—এসবে খুঁজে পাওয়া যায় কক্সবাজারের আমেজ। শিশুদের নানা রাইডও রয়েছে সমুদ্রসৈকতের আশপাশে।

পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত অবস্থিত কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। এখানে বসে উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। বিকেলের সময়টা অসাধারণ মনে হয় পর্যটকদের কাছে।

চট্টগ্রাম নগরের একপ্রান্তে অবস্থিত হলেও এখন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে খুব সহজেই পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে যাওয়া যায়। এক্সপ্রেসওয়ে ধরে যাওয়ার সময় কর্ণফুলী নদীর তীরে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো–নামানোর দৃশ্য মুগ্ধ করে যাত্রীদের। এ ছাড়া চট্টগ্রামের আউটার রিং রোড ধরে পতেঙ্গা পৌঁছানোও বেশ আনন্দের। এই সড়ক অনেকটা কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের মতো। সড়ক দিয়ে যেতে যেতে দেখা মেলে সাগরে ভাসমান মাছ ধরার নৌযান, পণ্যবাহী ছোট জাহাজসহ নানা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।

পতেঙ্গায় খাওয়াদাওয়ার জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত রেস্টুরেন্ট। এ ছাড়া সঙ্গে করে খাবার নিয়ে যাওয়া যায়। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের পাশেই রয়েছে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, প্রজাপতি পার্কসহ নানা জায়গা। চাইলে একসঙ্গে সেখানেও ঘুরে বেড়ানো যায়।

হ্রদ–পাহাড়ের ফয়’সলেক

ফয়’স লেক

পাহাড়-হ্রদের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি রোমাঞ্চকর নানা রাইডে মেতে ওঠা যায় চট্টগ্রাম নগরের খুলশী এলাকার ফয়’স লেকে। ১৯২৪ সালে এই হ্রদ খনন করা হয় তৎকালীন আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে। তখন এটি পাহাড়তলী লেক নামে পরিচিত ছিল। পরে ফয় নামে ইংরেজ এক রেল প্রকৌশলীর নামে একটি নামকরণ করা হয়।

২০০৪ সালে এই হ্রদকে কেন্দ্র করে একটি বিনোদন পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। ৩৩৬ একর জায়গার ওপর গড়ে ওঠা এই বিনোদনকেন্দ্রে নৌকা ভ্রমণ-ট্র্যাকিংয়ের সুযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি শিশুদের জন্য রয়েছে দোলনা, নাগরদোলা, বাম্পার কার, রোলার কোস্টার, পাইরেট শিপসহ নানা রাইড। এ ছাড়া ফয়’স লেকে ‘সি-ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি ওয়াটার থিম পার্ক রয়েছে। যেখানে পানি নিয়ে সারা দিন মাতামাতি করা যায়। সেখানেও সুযোগ রয়েছে রোমাঞ্চকর নানা রাইড উপভোগের।

দুই বছর আগে ফয়’স লেকে চালু হয়েছে ‘বেজক্যাম্প’। এখানে জিপলাইনে হ্রদ দেখা, গাছে ঝুলে রোমাঞ্চকর যাত্রা এবং কায়াকিং, আর্চারিসহ নানা সুযোগ রাখা হয়েছে। রয়েছে দৈত্যাকার দোলনা ও হ্যামকে দোল খাওয়ার ব্যবস্থাও।

ফয়’স লেকে প্রবেশের টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ৩০০ টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন রাইডের জন্য টাকা গুনতে হয়। সি-ওয়ার্ল্ড ও বেজক্যাম্পের জন্যও পৃথকভাবে পরিশোধ করতে হয় ফি।

বিনোদনকেন্দ্রটি পরিচালনায় রয়েছে কনকর্ড গ্রুপ।  প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ফয়’স লেকে আগে বুকিং দিয়ে দলবদ্ধভাবে গেলে প্রবেশ ফির ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। কমপক্ষে ১০ জনের জন্য আগে বুকিং দেওয়া হলে ৫০০ টাকার বিনিময়ে প্রবেশ ফির সঙ্গে পাঁচটি রাইড উপভোগের সুযোগ রয়েছে। ফয়’স লেকের মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পর নৌকায় করে সি-ওয়ার্ল্ডে যাওয়া এবং সেখানে সব রাইড উপভোগের জন্য ৭০০ টাকা ফি নির্ধারিত রয়েছে। তবে আগে কমপক্ষে ১০ জনের জন্য বুকিং দেওয়া হলে ৪৫০ টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। মূল ফটক দিয়ে না ঢুকে সরাসরি পৃথক ফটক দিয়েও সি-ওয়ার্ল্ডে গেলে খরচ কিছুটা কমে। ওই ফটক দিয়ে ঢোকার জন্য প্রতিজনকে দিতে হয় ৫০০ টাকা করে। নতুন করা বেজক্যাম্পের প্রবেশ ফি ৫০০ টাকা। জিপলাইন ও দোলনা ব্যবহারের জন্য আলাদা ফি দিতে হয় না। তবে অন্যান্য সেবা নিতে ফি দেওয়া লাগে।

কনকর্ডের ব্যবস্থাপক (বিপণন) বিশ্বজিৎ ঘোষ জানান, সব বয়সী মানুষের আনন্দ উদ্‌যাপনের জন্য খুবই চমৎকার একটি জায়গা ফয়’স লেক। এখানে রাতযাপনের সুযোগও রয়েছে। স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান-কনসার্টও এখানে হয়ে আসছে।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা

পরিবারের শিশু সদস্যদের নিয়ে সুন্দর ও শিক্ষামূলক সময় কাটানোর চমৎকার জায়গা চিড়িয়াখানা। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানাটি অবস্থিত ফয়’স লেকের পাশেই। বাঘ-সিংহ, ভালুকসহ নানা পশুপাখি রয়েছে এই চিড়িয়াখানায়।

১৯৮৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বল্প পরিসরে চিড়িয়াখানাটির যাত্রা শুরু হয়। তখন ভালুক, হরিণ, বানরসহ ছয়-সাতটি প্রজাতির প্রাণী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখন সময়ের সঙ্গে প্রাণীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে চিড়িয়াখানার পরিসরও। উদ্বোধনের সময় প্রায় পাঁচ একরের মতো জায়গা এই চিড়িয়াখানার জন্য নির্ধারণ করা হলেও বর্তমানে এর আয়তন প্রায় ১০ দশমিক ২ একর।

নানা ধরনের পশু-পাখির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পাশাপাশি এখানে শিশুদের খেলার জন্য রয়েছে দোলনা, স্লাইডসহ নানা আয়োজন। কিডস জোনে থাকা এসব রাইডের জন্য আলাদা করে ফি দিতে হয় না। চাইলে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর শাহাদাত হোসেন বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় প্রায় ৬৮ প্রজাতির ৫২০টি পশুপাখি রয়েছে। প্রবেশ ফি জনপ্রতি ৭০ টাকা।

ফয়’সলেক ওয়াটার পার্ক

ভাটিয়ারী হ্রদ, সানসেট পয়েন্ট

চট্টগ্রাম শহরের সিটি গেট থেকে মাত্র ২০ মিনিট দূরত্বের ভাটিয়ারীতে রয়েছে অসাধারণ প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য। ভাটিয়ারী-বড় দিঘির সড়ক হয়ে কিছু দূর এগোলোই দেখা মেলে পাহাড়-হ্রদের অপূর্ব দৃশ্য, যা দেখে মুহূর্তেই প্রশান্তি খুঁজে পান পর্যটকেরা। এখানে পাহাড়ের গায়ে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য রয়েছে সানসেট পয়েন্ট। হ্রদে নৌকাভ্রমণ বেশ আনন্দদায়ক।

ভাটিয়ারীর সানসেট পয়েন্ট ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় শীতকাল। এ সময়টাতে এই এলাকার আবহাওয়া বেশ শীতল ও মনোরম থাকে। সেনানিবাস এলাকা হওয়ায় ভাটিয়ারীর পাহাড়ি এলাকাটিতে নিরাপত্তা নিয়ে তেমন ভাবতে হয় না।

ভাটিয়ারীর এই স্থানের অদূরেই রয়েছে মাটিটা ইকো-রিসোর্ট। কায়াকিং, জিপ লাইনিং, আর্চারি, সাইক্লিংসহ নানা অ্যাকটিভিটির সুযোগ রয়েছে এখানে। চাইলে একই দিনে যেতে পারেন সেখানেও।

কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি

নগরের প্রবর্তক মোড়ের কাছেই বাদশা মিয়া সড়কে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে নিহত সৈনিকদের সমাধিস্থল। এটি কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্টি নামে পরিচিত। নিরিবিলি স্থানটি বিশেষ করে ইতিহাসপ্রিয় মানুষের কাছে ঘুরে বেড়ানোর প্রিয় একটি জায়গা।

ওয়ার সিমেট্রির প্রবেশপথেই উৎকীর্ণ রয়েছে এ এলাকায় সংঘটিত যুদ্ধে নিহত সৈন্য ও নাবিকদের পরিচিতি। সমাধিক্ষেত্রে সারিবদ্ধ ৭৫৫টি সমাধির প্রতিটিতে ছোট ছোট ফলকে লেখা নিহতের নাম, বয়স, পদবি, নিহত হওয়ার তারিখসহ নানা তথ্য। সাত একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত এই সমাধিক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতবর্ষের ২১৪ জন, যুক্তরাজ্যের ৩৭৫ জন, কানাডার ২৫ জন, অস্ট্রেলিয়ার ৯ জন, নিউজিল্যান্ডের ২ জন, বার্মার (মিয়ানমার) ২ জন, নেদারল্যান্ডসের ১ জন, আফ্রিকার ১০১ জন, যুক্তরাষ্ট্রের ১ জন এবং জাপানের ১৯ জন সমাহিত। প্রতিদিন অনেক মানুষ ওয়ার সিমেট্রি পরিদর্শনে যান। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বেলা ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এই সমাধি খোলা থাকে।

পারকি সৈকত

জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর

এশিয়া মহাদেশে থাকা দুটি জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের একটি চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক এলাকা আগ্রাবাদে অবস্থিত। অন্যটি রয়েছে জাপানের টোকিওতে। চট্টগ্রামের জাদুঘরটি আগ্রাবাদ মোড়ের কাছেই। এখানে ৪টি গ্যালারি ও ১টি বিশাল হলঘর রয়েছে। জাদুঘরের তিনটি গ্যালারিতে ২৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নানা রকমের অস্ত্র, ফুলদানি, কাপড়, নৌকা, অলংকার, বাঁশের পাইপ রয়েছে। অপর গ্যালারিতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, কিরগিজস্তানের কিছু সম্প্রদায়ের জীবনপ্রণালি সম্পর্কে তথ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা রয়েছে।

নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন উৎসব ও সংস্কৃতি সম্পর্কে দর্শনার্থীদের ধারণা দিতে হলরুমে রয়েছে দেয়ালচিত্র। রোববার ও সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত এই জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

পারকি সমুদ্রসৈকত

পারকি সমুদ্রসৈকত অবস্থিত চট্টগ্রাম নগর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের আনোয়ারা উপজেলায়। খুব অল্প সময়েই নগর থেকে এই সমুদ্রসৈকতে ঘুরে আসা যায়। কর্ণফুলী নদীর তলদেশের টানেল দিয়ে এখন সহজেই যাওয়া যায় পারকি সৈকতে। পারকির ঝাউবনে বসে একসঙ্গে বহির্নোঙরের জাহাজের আসা-যাওয়া ও সৈকতের লাল কাঁকড়ার দৌড়াদৌড়ি উপভোগ করা যায়।

বালুকাময় এ সৈকতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫ কিলোমিটার। প্রস্থ ২৫০ থেকে ৩০০ ফুটের মতো। জানা গেছে, ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর আনোয়ারা উপকূলকে রক্ষা করার জন্য পারকি ও আশপাশের এলাকায় বন বিভাগ ১৯৯৩-৯৪ এবং ২০০২ সালে পর্যায়ক্রমে প্রায় ৮০ হেক্টর জায়গায় ঝাউগাছ লাগায়। গাছগুলো বেড়ে ওঠার পর স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ঝাউবাগান বলে পরিচিতি পায়। আর্কিটেকচারাল পদ্ধতিতে লাগানো গাছগুলো এলাকার সৌন্দর্য বাড়ায় এবং পর্যটকদের কাছে দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠতে থাকে।