
প্রায় সাত বছর মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন সাদিকুল ইসলাম। মাঝেমধ্যে এদিক-সেদিক চলে যেতেন। কয়েক দিন পর ফিরেও আসতেন। আশপাশের মানুষকে করতেন জ্বালাতন। মা-বাবাকে শুনতে হতো পড়শিদের নানা অভিযোগ। এমন পরিস্থিতির মধ্যে ২০০১ সালে পারিবারিক সিদ্ধান্তে সাদিকুলের পায়ে পরল লোহার শিকল। এভাবেই কেটে গেছে সাতটি বছর।
২০০৭ সালের শেষ দিকে সাদিকুলের অসুস্থ ফুফুকে দেখতে পাশের উপজেলায় যান তাঁর মা সিদ্দিকা খাতুন। সেদিন পায়ের বাঁধন খোলা পেয়ে মাকে খুঁজতে বের হয়ে নিখোঁজ হন সাদিকুল। এরপর কেটে গেল প্রায় দেড় যুগ। সাদিকুলের খোঁজ না পেয়ে তত দিনে স্বজনদের চোখের জল শুকিয়েছে। সাদিকুল দীর্ঘ ১৭ বছর পর গত বুধবার বাড়িতে ফিরেছেন। এখন তিনি সুস্থ। তাঁকে ফিরে পেয়ে মা-বাবা ও স্বজনদের চোখে আনন্দাশ্রু।
সাদিকুল ইসলামের বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ভোগনগর ইউনিয়নের দলুয়া গ্রামে। বাবা আকবর আলী (৭৩) পেশায় কৃষক। চার ভাই এক বোনের মধ্যে সাদিকুলই বড়। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর বাড়ি ঘুরে দেখা যায়, উঠানে বিভিন্ন বয়সী শ খানেক নারী-পুরুষের জটলা। মা-বাবার মাঝখানে বেঞ্চে বসে আছেন প্রায় ৪৫ বছর বয়সী সাদিকুল। লম্বা-পাতলা গড়নের মানুষটির হাসোজ্জ্বল মুখ। বেশির ভাগ চুল পাক ধরা। মুখে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শৈশব-কৈশোরের বন্ধু, স্বজন ও পড়শিরা দেখতে এসেছেন তাঁকে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসছে। সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে চলেছেন সাদিকুল।
সেখানে আলাপকালে সাদিকুলের মা সিদ্দিকা খাতুন বলছিলেন, ‘হামার ছেলে ফিরে আসিছে। হামার আর কিছু দরকার নাই। কত জায়গায় খুঁজিছি, কত বাড়ি ঘুরিছি। যারা হামার ছেলেক এত দিন দেখিশুনে রাখিছে, আল্লাহ ওমার ভালো করুক।’
সাদিকুল বিবাহিত। ১৯৯৯ সালে বিয়ে করেন। ছোটবেলায় পড়াশোনা না করায় বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। সাদিকুলের এক ছেলেসন্তানও আছে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়লে স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান।
সাদিকুল ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত পুলিশের কয়েকজন সদস্য সাদিকুলকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে তাঁকে উদ্ধার করে কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় পাভলভ সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। এই হাসপাতালে মানসিক ভারসাম্যহীনদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। যদিও ২০০৭ সালের শেষ দিকে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হন সাদিকুল। তবে এই আট বছর কীভাবে কেটেছে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কীভাবে কলকাতায় গেলেন, কিছুই মনে নেই তাঁর।
কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের নাম ‘অঞ্জলী’। পশ্চিমবঙ্গে পাভলভ হাসপাতালের মতো আরও কয়েকটি হাসপাতাল আছে। এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে আসা ব্যক্তিদের বাড়িতে ফেরানো ও কর্ম-উদ্দীপনা তৈরি করতে কাজ করে অঞ্জলী। বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোর এই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় অঞ্জলীর সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার শুক্লা দাস বড়ুয়ার সঙ্গে। যিনি শক্তি-সাহস, অনুপ্রেরণা দিয়ে সাদিকুলকে মা-বাবার কাছে ফিরে আসাতে সহযোগিতা করেছেন। আলাপচারিতায় সাদিকুলও শুক্লা দাসের প্রশংসা করলেন, জানালেন কৃতজ্ঞতা।
শুক্লা দাস বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই সুস্থ হতে শুরু করেন সাদিকুল। এরপর ধীরে ধীরে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের লন্ড্রি প্রজেক্টে কাজ শুরু করেন। তিনি তাঁর বাড়ির পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা ঠিকমতো বলতে পারছিলেন না। ফলে তাঁকে ফেরত পাঠানো বেশ কঠিনই ছিল। এরই মধ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে গঠিত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে ট্রাভেল পারমিট পাওয়া যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কিংবা সাদিকুলকে সঠিকভাবে বাড়ি পৌঁছানোর বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন তাঁরা। এ সময় অঞ্জলীর কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় কলকাতাপ্রবাসী সমাজকর্মী নাতাশা আহমেদের সঙ্গে। তিনি তাঁর বন্ধু বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিজানুর রহমানকে সাদিকুলের বিষয়ে জানান।
আমরা পিঠাপিঠি ভাই। ছোটবেলায় ভাইয়ের কত আদর-স্নেহ পাইছি। বেনাপোল সীমান্তে যখন ভাইকে দেখতে পেলাম, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। আজকে বাড়িটা আনন্দে ভরে গেছে আমাদের।আজিজুল, সাদিকুলের ভাই
শুক্লা দাস বলেন, ‘ও (সাদিকুল) খুব সহজ-সরল স্বভাবের। কাজের প্রতিও আন্তরিক। বর্তমানে সে সম্পূর্ণ সুস্থ। শুধু রাতে একটা ওষুধ সেবন করতে হয়। তবে সাদিকুলের মতো আর ১০-১২ জন বাংলাদেশি ওসব হসপিটালে চিকিৎসাধীন আছেন।’
এবার সাদিকুলের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করতে কাজ শুরু করেন আইনজীবী মিজানুর রহমান। বন্ধু নাতাশার মাধ্যমে ভিডিও কলে কথা বলেন সাদিকুলের সঙ্গে। গ্রামের নাম দলুয়া এবং একটি হিমাগারের পাশে সাদিকুলের খালার বাড়ি এটুকুই বলতে পারছিলেন। এই মাসের শুরুতে সেই সূত্র ধরে মিজানুর রহমান খুঁজে পান সাদিকুলের ভাই আজিজুলকে (৪০)। পেট ও হাতের কাটা দাগ দেখে পরিবারের সদস্যরাও শনাক্ত করেন সাদিকুলকে। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর দুই দেশের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সাদিকুলের মতো আরও ২৫ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
সাদিকুলের ভাই আজিজুল বলেন, ‘আমরা পিঠাপিঠি ভাই। ছোটবেলায় ভাইয়ের কত আদর-স্নেহ পাইছি। বেনাপোল সীমান্তে যখন ভাইকে দেখতে পেলাম, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। আজকে বাড়িটা আনন্দে ভরে গেছে আমাদের। চার ভাইয়ের একমাত্র বোন লাইলি যে সব সময় বড় ভাইয়ের কথা বলত, আজকে ওর আনন্দে আমরা আরও বেশি খুশি।’
এত বছর পর দেশে ও স্বজনদের কাছে ফেরার প্রতিক্রিয়ায় সাদিকুল বলেন, অনেক কিছুই মনে নেই। মনে করতে পারলেও সময় লাগে অনেকক্ষণ। তাঁর বাবাকে প্রথমে চিনতে কষ্ট হয়েছে। কিন্তু মাকে ঠিকই চিনেছেন। তিনি তো পড়ালেখা জানেন না, কৃষিকাজ করতেন। ভাইদের সঙ্গে আলোচনা করে আবার কৃষিকাজেই মনোযোগ দেবেন। তবে একটু বিশ্রাম নিতে হবে।