
বরিশাল শহরে একসময় শিরার মতো ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য খাল। সেসব খালে শীতের কুয়াশা ভেদ করে ছোট ছোট নৌকায় গ্রাম থেকে শাকসবজিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য আসত শহরে। শহরের আকাশে ঘুরে বেড়াত শঙ্খচিল। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন, শিশিরভেজা সকাল নামত এখানে। সেই অপার্থিব আবহের শীতের সকালের প্রকৃতিতে মজেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। সেই রূপে মোহিত কবি তাঁর ‘কুড়ি বছর পরে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘সোনালী সোনালী চিল-শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে/কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!’ ঋতু-প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবির জন্মশহরের এখন আর সেই জৌলুশময় শিশিরভেজা সকাল নেই। তবু যা আছে, তা দেশের অন্য বড় শহরের তুলনায় ভালো। শিশিরের জলরঙে আঁকা শীতের ভোর এখানে মুগ্ধতা ছড়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুরা খেয়ালি হলেও এখনো বাংলার প্রকৃতিতে শীত আসে লেপ, কাঁথা, ধূমায়িত চায়ের কাপে; গায়ে মিষ্টি রোদ্দুরের গন্ধ মেখে মেখে। হয়তো নগরে ও গ্রামে সেই শীতের সৌন্দর্য ভিন্নতর। ভোরবেলা বাইরে নামতেই হিমভেজা কনকনে বাতাস। কুয়াশায় মোড়ানো বরিশাল নগরের ফাঁকা সড়কে, উদ্যানে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের দেখা মেলে। কুয়াশায় মোড়ানো ভোরগুলো দাগ পড়া কাচের মতো অস্বচ্ছ, অপার্থিব লাগে।
এই শহরে জন্ম, এখানেই বেড়ে উঠেছেন প্রকৃতিপ্রেমী কাজী মিজানুর রহমান ফিরোজ। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি প্রতিদিন সকালে প্রাতর্ভ্রমণ করেন। কাজ করেন পরিবেশ নিয়ে। গ্রিন মুভমেন্ট নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি নগরের পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই শহরের একাল-সেকাল। ছোটবেলার শীতকাল নিয়ে তিনি বলেন, শীতের সকালগুলো মনভোলানো ছিল। নবগ্রাম খালে পানির প্রবাহ ছিল। গাঢ় কুয়াশা আর কনকনে শীতে চাদর মুড়িয়ে তাঁরা সকালে বাইরে বের হতেন। নবগ্রাম খাল ধরে ছোট ছোট ডিঙিতে করে সবজি নিয়ে কৃষকেরা বটতলা বাজারে আসতেন। মাটির হাঁড়িতে করে খেজুরের রস নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন গাছিরা।
কাজী মিজানুর রহমান ফিরোজ বললেন, ‘শীতের সকালে এখন যখন প্রাতর্ভ্রমণের জন্য হেঁটে রাজাবাহাদুর সড়কের পথ ধরে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে যাই, তখন শীতের সেই পুরোনো মধুর স্মৃতি চোখে ভেসে ওঠে সড়কের দুই পাশের শতবর্ষের পুরোনো গাছ আর তাদের ছড়িয়ে থাকা ডালপালা দেখে। এসব গাছের পাতাগুলো হিমেল বাতাসে দোল খায়, শিশিরকণাগুলো মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করে, কিন্তু নগরায়ণের ফলে শীতের সেই আমেজ এখন আর বরিশালে নেই। ইট-কাঠ-পাথরের দেয়াল-বাড়ি আর গাড়ির অবিরাম ছোটাছুটিতে শীতের প্রভাবও এখন কম। কিন্তু শহরের তুলনায় এখনো গ্রামে শীতের তীব্রতা বেশি, সেই সঙ্গে আমেজ আর ঐতিহ্যের কিছুটা টিকে আছে।’
কাজী মিজানুর রহমান ফিরোজ আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘নগরায়ণের ভিড়ে নগরের ২৪টি খালের অস্তিত্ব এখন আর নেই। দিঘি-পুকুরগুলো ভরাট করে সেখানে এখন বহুতল ভবন। সৌন্দর্যবর্ধনের নামে শত বছরের পুরোনো অনেক বৃক্ষ মেরে ফেলা হচ্ছে। প্রকৃতির করুণ আর্তনাদ হয়তো আমরা শুনতে পাই না, তবু যা যাওয়ার গেছে। এখনো যা টিকে আছে, সেগুলো যেন রক্ষা পায়; সেই আকুতি আমাদের। প্রকৃতি আর আমাদের আকুতি আজ একাত্ম। উন্নয়নের ডামাডোলে যেন তা মিইয়ে না যায়।’