
ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দেওয়া, চেক জালিয়াতি ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তা শাস্তি ভোগ করেছেন তিনবার। সম্প্রতি তাঁর সব শাস্তির আদেশ প্রত্যাহার করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে শাস্তির কারণে কেটে নেওয়া বেতন-ভাতার ১৫ লাখ টাকাও তাঁকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে।
গত এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. ওসমান গণির সব শাস্তি প্রত্যাহার করে নেয় বোর্ড কর্তৃপক্ষ। শাস্তি প্রত্যাহারের চিঠি দেওয়া হয় চলতি বছরের ৯ এপ্রিল। অথচ আদেশ কার্যকরের তারিখ দেওয়া হয় ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে। অর্থাৎ ১০ বছরের তাঁর সব শাস্তি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফলে শাস্তির কারণে কেটে নেওয়া সব বেতন-ভাতা এককালীন পেয়ে যান ওসমান গণি।
বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, শাস্তি প্রত্যাহার হয়েছে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশে। সেখানে বোর্ড সচিবের সই থাকার কথা। তবে তিনি সই করতে আপত্তি করলে পরে উপসচিব ও সহকারী সচিবকে সই করতে বলা হয়। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা থাকতে তাঁরা সই করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এরপর চেয়ারম্যানের নির্দেশে সই করেন বোর্ডের সহকারী কর্মকর্তা বিমল কান্তি চাকমা।
শিক্ষা বোর্ডের সচিব এ কে এম সামছু উদ্দিন আজাদ মনে করেন ওসমান গণির শাস্তি প্রত্যাহারের ক্ষেত্র যথাযথ প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করা হয়নি। সে কারণে এ-সংক্রান্ত আদেশেও তিনি সই করেননি বলে জানান। পাশাপাশি এভাবে শাস্তি প্রত্যাহারের সুযোগও বোর্ড কর্তৃপক্ষের নেই বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ডের আইন উপদেষ্টা। তাঁর মতে, শাস্তি প্রত্যাহার করার এখতিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সেটি না মেনেই ওসমান গণির শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁকে এখন সহকারী সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও বসানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৯৭ সালে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন ওসমান গণি। ১৯৯৯ সালে তাঁকে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে অফিস সহকারী নিয়োগ দেয় বোর্ড। পরে পদ খালি হলে তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চার বছর পর তাঁকে সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০১ সালে যোগদানের সময় কক্সবাজার পৌরসভায় চার বছর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতার সনদ জমা দেন তিনি। তবে অভিযোগ ওঠে অভিজ্ঞতার সনদটি জাল।
এ নিয়ে ২০০৫ সালে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে নিয়োগ পরীক্ষার ৪ বছর পর নিয়োগের বিষয়টি যুক্তিসংগত নয় বলে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তদন্ত কমিটির সদস্য এবং বোর্ডের তৎকালীন উপসচিব (বর্তমানে অবসরে) মো. নুরুন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তদন্তে গিয়ে অভিজ্ঞতা সনদটি ভুয়া বলে প্রমাণ পাই।’
এ ঘটনার সময় জালিয়াতির মাধ্যমে কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষকের চেক নগদায়ন করার অভিযোগ ওঠে ওসমানের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ২০০৫ সালে প্রথমবারের মতো সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি। এরপর ২০১৫ সালের হাইকোর্টের ভুয়া রিট আদেশ দেখিয়ে নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ দিতে টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। সে সময় আবারও বরখাস্ত হন তিনি।
সবশেষ ২০২২ সালে বোর্ডের ইফতার মাহফিলে মারামারির কারণে তৃতীয়বার সাময়িক বরখাস্ত হন তিনি। এসব ক্ষেত্রে তাঁকে আর্থিকভাবে শাস্তি দেওয়া হয় এবং বেতন স্কেলের সর্বনিম্ন ধাপে নামিয়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি তাঁর শাস্তি প্রত্যাহার করার পর কেটে নেওয়া ১৫ লাখ টাকা আবার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বোর্ডের দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘তিনি দক্ষিণ জেলা মৎস্যজীবী লীগের সদস্য। তিনবার বরখাস্ত হওয়ার পর তাঁকে এখন বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে বসানো হয়েছে। এখন তিনি সহকারী সচিব। আইনি সমস্যা না থাকলেও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে এ পদে বসানো একপ্রকার পদোন্নতি।’
তিনবার বরখাস্তের বিষয়টি স্বীকার করে বোর্ডের সহকারী সচিব ওসমান গণি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোর্ডের একজন কর্মকর্তা অভিযোগগুলো করছিলেন আমাকে ওপরে উঠতে না দেওয়ার জন্য।’
শিক্ষা বোর্ডের ঢাকায় ও চট্টগ্রামে দুজন আইন উপদেষ্টা আছেন। ঢাকায় আইন উপদেষ্টা (অস্থায়ী) হিসেবে আছেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম। ওসমান গণির শাস্তি প্রত্যাহারের বিষয়ে গত বছর মতামত দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধ্যাদেশ, চট্টগ্রাম বোর্ডের কর্মচারী চাকরি প্রবিধান ও সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী, চেয়ারম্যান এই শাস্তি প্রত্যাহার করতে পারেন না।
জানা গেছে, ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামেও একই নামে একজন আইন উপদেষ্টা ছিলেন শিক্ষা বোর্ডের। তবে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নুরুল আমিন নামের নতুন একজন আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। গত মার্চে ওসমান গণির শাস্তি প্রত্যাহারের পক্ষে মতামত দেন ওই আইনজীবী।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম বোর্ড চেয়ারম্যান ইলিয়াছ উদ্দিন আহাম্মদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই শাস্তি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগের যে প্রতিবেদন, সেখানে একই কমিটি দুই ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছে। সেখানে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল বলে রিভিউ কমিটি জানিয়েছে। সব শাখাপ্রধানের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।