১০ বছর বয়সে বাবার কাছে শেখা, এখনো লাশ কেটে যাচ্ছেন তিনি

চয়ন ডোমের বয়স এখন ২৭। তারুণ্যের এই দীপ্ত সময়ে তিনি এখন পুরোদস্তুর একজন লাশকাটা ডোম
ছবি: প্রথম আলো

বয়স যখন ১০ ছিল, তখন বাবার সঙ্গে লাশকাটা ঘরে ঢুকে পড়েন চয়ন ডোম। ময়নাতদন্তের মতো দুঃসাহসী আর কঠিন একটি কাজে জড়ান নিজেকে। চয়ন ডোমের বয়স এখন ২৭। তিনি এখন পুরোদস্তুর একজন লাশকাটা ডোম। কাজ করেন পিরোজপুর সদর হাসপাতালের মর্গে।

পিরোজপুর শহরের হরিজন কলোনিতে পরিবারের সঙ্গে চয়নের বসবাস। চার পুরুষ ধরে চয়নের পরিবার হাসপাতালের মর্গে লাশ কাটার পেশায় জড়িত। চয়নের দাদা ফাল্গুনী ডোম পিরোজপুর সদর হাসপাতালে লাশ কাটার কাজ করতেন। ১৯৯০ সালে তিনি সরকারি চাকরির ওই পদ থেকে অবসর নিলে সেখানে যোগ দেন চয়নের বাবা পান্নালাল ডোম। অল্প বয়সেই বাবার সহকারী হন চয়ন। চার বছর আগে বাবা অবসর নেওয়ায় এখন কাজটি করে যাচ্ছেন চয়ন। তাঁকে সহায়তা করেন মা দুলালী রানী (৫৫)।

চয়ন ডোম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাবা লাশ কাটেন। সে কাজে সহযোগিতা করতেন মা। আমি তাঁদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতাম। কখনো কখনো আমাকে লাশকাটা ঘরে নিয়ে যেতেন। আমার সামনেই লাশের ময়নাতদন্তের কাজ করতেন তাঁরা। দেখতে দেখতে বড় হয়েছি, কখনো ভয় লাগেনি। আমি ভাবতাম, কবে বাবার সঙ্গে লাশ কাটব। আগ্রহ দেখে ১০ বছর বয়সেই আমাকে লাশ কাটা শেখানো শুরু করেন বাবা। সেই থেকে ১৭ বছর ধরে লাশ কেটে যাচ্ছি।’

চয়নের চাকরিটি এখনো সরকারীকরণ হয়নি। লাশ কেটে রোগীর স্বজনেরা বা পুলিশ যে টাকা দেয়, তা দিয়েই চয়নের সংসার চলে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার চালাতে তাই বেশ হিমশিম খেতে হয়। তিনি বলেন, ‘চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় হতাশ হয়ে এ পেশা ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে। কারণ, এ পেশার কারণে অন্য কোনো কাজে যুক্ত হতে পারছি না। সব সময় লাশের অপেক্ষায় থাকতে হয়। চার পুরুষের পেশা, তাই ছাড়তে পারছি না। তবে আমার সন্তান ও স্বজনদের এ পেশায় যুক্ত করার ইচ্ছে নেই। তাদের পড়াশোনা করাতে চাই।’

লাশকাটা জীবনের কথা জানিয়ে চয়ন ডোম বলেন, ‘লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে আমাদের কাছে ফোন আসে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে এরপর লাশকাটা ঘরে লাশ আনা হয়। সেখানে ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসকের উপস্থিতিতে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী লাশ কাটি। এ কাজ করতে আধা ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। মাঝেমধ্যে কবর থেকে লাশ উত্তোলনের জন্যও আমাদের ডাকা হয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসে লাশ কাটা হয়। তবে বেশির ভাগ সময় অলস পার করতে হয়। এ পেশায় কখন ডাক আসে বলা যায় না। সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। এ জন্য অন্য কাজ করা যায় না। ধরুন আমি অন্য কাজে গেলাম। হঠাৎ ফোন এল লাশ কাটার জন্য। তখন ওই কাজ বন্ধ রেখেই তো লাশ কাটতে যেতে হবে।’

লাশকাটা পেশায় মানুষের আগ্রহ তেমন একটা নেই জানিয়ে চয়ন ডোমের বাবা পান্নালাল ডোম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বংশপরম্পরায় যাঁরা এ পেশায় যুক্ত, তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ ডোম হতে চান না। ডোমের চাকরি সরকারি না হলে ভবিষ্যতে এ পেশায় যুক্ত হওয়ার আগ্রহ কমে যাবে।’

পিরোজপুরের সিভিল সার্জন মো. হাসনাত ইউসুফ বলেন, ‘সদর হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির ডোমের একটি পদ আছে। ওই পদ থেকে পান্নালাল ডোম অবসরে যাওয়ায় পদটি শূন্য আছে। চতুর্থ শ্রেণির পদের নিয়োগ বন্ধ থাকায় ওই পদে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। তবে পান্নালাল ডোমের ছেলে চয়ন ডোমকে দিয়ে আমরা ডোমের কাজটি করাচ্ছি।’