রাজশাহীতে বরেন্দ্র জাদুঘর প্রাঙ্গণে ঐতিহ্য ও শিল্প সংস্কৃতির মেলার স্টলে দর্শনার্থীদের ভিড়। শুক্রবার দুপুরে
রাজশাহীতে বরেন্দ্র জাদুঘর প্রাঙ্গণে ঐতিহ্য ও শিল্প সংস্কৃতির মেলার স্টলে দর্শনার্থীদের ভিড়। শুক্রবার দুপুরে

বরেন্দ্র জাদুঘর প্রাঙ্গণে নতুন-পুরোনোর মিলনমেলা

প্রত্নবস্তুটির নাম কুষাণ মুদ্রা। এটি একটি স্বর্ণমুদ্রা। বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে পাওয়া গেছে। পোস্টারে দেওয়া আছে মুদ্রাটির রঙিন ছবি, আয়তন, সংগ্রহ নম্বর, তৈরির উপাদান ও ইতিহাস। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সাড়ে ১৭ হাজারের বেশি প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের ভেতর থেকে ২৫টি প্রত্নবস্তুর পোস্টার প্রদর্শনী মেলায় স্থান পেয়েছে।

সেই সঙ্গে হালের কাঁসা-পিতল, মাটি ও বেতের তৈরি জিনিসপত্র, হাতে তৈরি অলংকার, পুলি পিঠা থেকে শুরু করে রাজশাহী অঞ্চলের নতুন ঐতিহ্য কালাই রুটি মেলার স্টলগুলোতে আছে। শুক্রবার রাজশাহী নগরের বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী এমনই নতুন-পুরোনো ঐতিহ্যের মিলনমেলা বসেছিল।

জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে যেসব স্থানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঝুঁকির মুখে, সেসব স্থানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষার পাশাপাশি সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে কাজ করে যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর কালচারের কালচারাল প্রোটেকশন ফান্ড। ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) অধ্যাপক ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক শাহনাজ হুসনে জাহান বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের জন্য একটি প্রকল্প দিতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কালচারাল প্রোটেকশন ফান্ডে আবেদন করেছিলেন। তারপর এখানে অর্থায়ন হয়। সেই অর্থে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের নেতৃত্বে ছিলেন যুক্তরাজ্যের দারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবিন কনিংহম। দলে ছিলেন অধ্যাপক এমিলি উইলিয়ামস, মার্ক ম্যানুয়েল, ক্রিস্টফার ডেভিস ও বাংলাদেশের ইউল্যাবের শাহনাজ হুসনে জাহান। দেড় বছরের এ প্রশিক্ষণ কর্মশালা শেষে এক দিনের এই ঐতিহ্য উৎসবের আয়োজন করা হয়।

বরেন্দ্র জাদুঘর প্রাঙ্গণে শুক্রবার সকালে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রশিক্ষকেরাও। সকালে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা ছিল। বিকেলে ছিল ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা ও আলকাপ গানের আসর। দুপুরে জাদুঘর প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, ঐতিহ্য উৎসব ঘিরে পুরো জাদুঘরই সাজানো হয়েছে। পথগুলোতে আঁকা হয়েছে আলপনা। এ দিন বিনা মূল্যে জাদুঘরে প্রবেশের সুযোগ ছিল। দর্শনার্থীরা জাদুঘরে ঢুকে প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন দেখেন। ঘুরে দেখেন ঐতিহ্য মেলা।

প্রত্নবস্তুর পোস্টার প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীবসহ অতিথিরা

প্রশিক্ষক দল সাড়ে ১৭ হাজারের বেশি প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের মধ্য থেকে ২৫টি ঐতিহ্যকে বাছাই করেছেন। এগুলো প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসকে তুলে ধরে। এসব প্রত্নতত্ত্ব নির্দশনের পোস্টার রাখা হয়েছে জাদুঘর প্রাঙ্গণজুড়ে। দর্শনার্থীরা এসে এসব পোস্টারে লেখা বিবরণ থেকে ইতিহাস জেনে নেন। সেখানে আলাপকালে রাজশাহী সিটি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানভীর হক বললেন, এটা একটা খুশির খবর যে জাদুঘর প্রাঙ্গণে এমন একটি মেলার আয়োজন করা হয়েছে। তবে এটির প্রচার আরও একটু বেশি হওয়া দরকার ছিল, তাহলে শিক্ষার্থীসহ আরও অনেক মানুষ মেলায় আসার সুযোগ পেতেন। আর ডিসপ্লের সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার ছিল।

নগরের বিবি হিন্দু একাডেমির প্রধান শিক্ষক রাজেন্দ্রনাথ সরকার এসেছিলেন সপরিবার। তিনি স্টল থেকে রকমারি পিঠা কিনে নিয়েছিলেন। বললেন, ‘এই আয়োজন চমৎকার। এর যে মূল উদ্দেশ্য, আমাদের যে সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে এবং বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তা সবার সামনে উপস্থাপন করা। এটিকে আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা উচিত। তাহলে মানুষ বুঝতে পারবে, আমাদের ইতিহাস অনেক বেশি সমৃদ্ধ।’

রাজশাহীতে বরেন্দ্র জাদুঘর প্রাঙ্গণে ঐতিহ্য ও শিল্প সংস্কৃতির মেলায় সাঁওতাল শিল্পীদের দল

ইউল্যাবের অধ্যাপক ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, ‘এখানে সাড়ে ১৭ হাজারের বেশি প্রত্নবস্তু সংরক্ষিত আছে। এর মধ্য থেকে ২৫টি প্রত্নবস্তু নির্বাচন করে এর ইতিহাস আমরা আলাদাভাবে তুলে ধরেছি। পাশাপাশি বর্তমান সময়ের ঐতিহ্যগুলো মেলায় এসেছে। এটি মূর্ত ঐতিহ্যের সঙ্গে বিমূর্ত ঐতিহ্যের একটা মিলনমেলা।’

শাহনাজ হুসনে জাহানের ভাষ্য, প্রকল্পের অধীনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এই জাদুঘরের পরিচালক থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিছু প্রশিক্ষণ হয়েছে অনলাইনে, হাতে–কলমে কিছু প্রশিক্ষণ হয়েছে জাদুঘরেই। এর মাধ্যমে সবাই জানতে পেরেছেন কীভাবে একটা প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহ করতে হবে, কীভাবে লিপিবদ্ধ ও নথিভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া প্রত্নবস্তুর বর্ণনায় কী কী বিষয় থাকবে, স্থানীয় জনপ্রবাদগুলো কীভাবে থাকবে, গল্পগুলো কীভাবে বলতে হবে, ইতিহাসটাকে কীভাবে পুনর্গঠন করা হবে, কীভাবে ছবি, থ্রি–ডি প্রস্তুত করা হবে, কীভাবে রাখা হবে বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেমন হবে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সবকিছুই সংরক্ষণ হবে।