মনিরুজ্জামান এলাকার এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে ১৯৮৬ সাল থেকে পত্রিকা বিলি করেন
মনিরুজ্জামান এলাকার এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে ১৯৮৬ সাল থেকে পত্রিকা বিলি করেন

৮০ বছর বয়সেও পত্রিকা বিলি করে চলেছেন রাজশাহীর মনিরুজ্জামান

প্রতিদিন রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে যায় রাজশাহীর পবার মনিরুজ্জামানের (৮০)। তিনটার পর আর ঘুমাতে পারেন না। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সকাল সাতটা নাগাদ রাজশাহী শহরে এসে পৌঁছান। তারপর সাইকেলে ঘুরে ঘুরে পত্রিকা বিলি করে বাড়ি ফিরতে তাঁর বিকেল সাড়ে পাঁচটা বেজে যায়। প্রায় ৪০ বছর ধরে এই রুটিনে চলছে তাঁর জীবন।

পত্রিকা বিক্রি করে মনিরুজ্জামান তাঁর আট ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত করেছেন। তাঁর বাড়ি পবা উপজেলার খোলাবোনা গ্রামে। গ্রামটি শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে। মনিরুজ্জামান দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই এসএসসি পাস করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বাবা জার্জিস আলী সরকার, বড় ভাই এমাজ উদ্দিন, বড় চাচা সামাউন আলী সরকার, দুই মামা আসাদুজ্জামান ও শাহজাহান আলী শহীদ হন। এই স্বজনদের যখন ধরে নেওয়া হয়, তখন সেই দলে মনিরুজ্জামানও ছিলেন। তাঁর বাবা তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য খুব অনুরোধ করছিলেন। এই ফাঁকে তিনি দৌড়ে পালিয়ে যান।

বেঁচে যান মনিরুজ্জামান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাবালক ছয় ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। ভাইদের মানুষ করার জন্য তিনি মাঠে কাজ করেছেন। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৮৬ সালের দিকে এসে তাঁর মনে হলো এভাবে তিনি আর চলতে পারছেন না। তখন এলাকার এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। এভাবেই ভাইদের লেখাপড়া করিয়েছেন। সবচেয়ে ছোট ভাই প্রকৌশলী হয়েছেন।

মনিরুজ্জামানের বাড়িতে যাওয়ার পথে তাঁর নাম শুনেই বাড়ির অবস্থান বলে দিলেন কয়েকজন। রাস্তা থেকে একটু নিচে তাঁর বাড়িটি। যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। এদিক-সেদিক করে নেমে যেতে হলো। বাড়ির দরজায় কড়া নাড়লেও কেউ কোনো শব্দ করলেন না। পরে একটি মেয়ে ভেতরে থেকে সাড়া দেন। পরিচয়ে জানা গেল, তিনি মনিরুজ্জামানের মেয়ে। রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে বাংলায় স্নাতক শ্রেণিতে পড়েন। বললেন, ‘বাবা এখনি বাগানের দিকে ছাগল চরাতে গেলেন।’ বাগানে গিয়ে তাঁকে পাওয়া গেল না। রাতে তিনি ফোন করলেন। কথা হলো।

মনিরুজ্জামান ছোট-বড় মিলে ২০০ পত্রিকা প্রতিদিন বিক্রি করেন।

মনিরুজ্জামান বলেন, এখন তিনি ছোট-বড় মিলে ২০০ পত্রিকা প্রতিদিন বিক্রি করেন। রাজশাহী শহরের ভেতরেই তাঁর ১০০ থেকে ১২৫ জন গ্রাহক আছেন। সকাল সাতটা থেকে পত্রিকা বিক্রি শুরু করেন। শহর থেকে বের হতেই দুপুর ১২টা বেজে যায়। শেষ করেন জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়িহাট এলাকায়। আগে গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়ন পর্যন্ত যেতেন। এখন পত্রিকা কমে যাওয়ার কারণে তিনি ওই এলাকা ছেড়ে দিয়েছেন।

মাদ্রাসার চাকরি ছেড়ে দিয়ে পত্রিকা বিক্রি করার সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল কি না, তা জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি। আমার আট ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। ছয় মেয়ের বড় চারটিই মাস্টার্স পাস করেছে। ছোট দুটিও পড়ছে। বড় ছেলেটা রাজশাহী থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করার পর ঢাকায় বিএসসি করছে। ছোট ছেলে রসায়নে অনার্স করছে। আমি হালাল রুজিতে বিশ্বাস করি। সবই করেছি পত্রিকার ওপর দিয়ে।’

পরিবার ও গ্রামের কয়েকজনের ভাষ্য, শীত-গ্রীষ্ম, রোদ-বৃষ্টি—সব মাথায় নিয়ে প্রতিদিন সাইকেলে চড়ে পত্রিকা বিলি করেন মনিরুজ্জামান। তিনি সুস্থ আছেন। নিয়মিত কোনো ওষুধ তাঁকে খেতে হয় না। সব সময় কথা বলেন হেসে হেসে।

রাজশাহী নগরের হড়গ্রাম এলাকার একজন স্কুলশিক্ষক শরিফ আহমেদ বলেন, ‘আমি যখন ছাত্র ছিলাম, তখন মনিরুজ্জামান পত্রিকার এজেন্ট ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে পত্রিকা নিয়ে বিক্রি করতাম। চাকরি পাওয়ার পর ওই ব্যবসা ছেড়ে দিই। কিন্তু মনিরুজ্জামানের কাছ থেকে গ্রাহক হিসেবে পত্রিকা নিয়ে আজও পড়ছি।’

রাজশাহীর খবরের কাগজের একজন পুরোনো এজেন্ট ছিলেন মো. হেকমত উল্লাহ। তিনি ৫৬ বছর ধরে পত্রিকার ব্যবসা করেছেন। তাঁর কাছ থেকে শুরু থেকে পত্রিকা নিতেন মনিরুজ্জামান। হেকমতের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ (৪৭) এখন ব্যবসা দেখাশোনা করেন। তিনি বলেন, ‘মনিরুজ্জামানের লেনদেন খুব ভালো। তিনি একজন ভালো ব্যবসায়ী।’