ফসল রক্ষায় পাখি তাড়াতে আমন ধানের খেতে পুঁতে রাখা হয়েছে কাকতাড়ুয়া। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মল্লিকসরাই মাঠে
ফসল রক্ষায় পাখি তাড়াতে আমন ধানের খেতে পুঁতে রাখা হয়েছে কাকতাড়ুয়া। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মল্লিকসরাই মাঠে

মৌলভীবাজারের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে মায়াবী সবুজ ধান

গ্রামীণ সড়ক ধরে পথ চলতে চলতে যত দূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন রোদমাখা ধানের সবুজ। এই পথ ও এই মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যত দূর যাওয়া যায়, মন জুড়িয়ে থাকে সবুজে। এমন সবুজ খেতের দিকে তাকিয়ে একদিন হয়তো কবি জীবনানন্দ দাশের চোখ স্থির হয়েছিল। মন তাঁর কেঁদে ওঠেছিল, ‘আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে/ জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়।’

মৌলভীবাজারের বিভিন্ন দিকে আমন ধানের মাঠ এখন মায়ের আঁচলের মতো স্বস্তি ও শান্তির বিস্তৃত সবুজে ছেয়ে আছে। এই মাঠ থেকে, এই সবুজ থেকে চোখ ফেরানো দায়। এবার সময়োপযোগী ও পরিমিত বৃষ্টি হয়েছে। বন্যা বা পোকামাকড়ের আক্রমণে বড় কোনো দুর্যোগে পড়েনি আমনের ফসল। মাঠের দিকে তাকিয়ে ভালো ফসল পাওয়ার আশায় আছেন কৃষকেরা।

গত বুধবার সকালে মৌলভীবাজার–কুলাউড়া সড়কের চাঁদনীঘাট থেকে উত্তর দিকে কিছুদূর যেতেই যেন মাঠগুলো মেলে ধরে তার সবুজ মায়াবী খোলা আঁচল। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে শুধু ধানের সবুজ, সবুজের প্রান্তর পার হওয়া মায়া। রাতের শিশির তখনো ধানের পাতায় পাতায় লেগে আছে। ফোঁটা ফোঁটা জল দিনের প্রথম রোদে জ্বলজ্বল করছে। কোথাও সবুজ পাতার বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে কচি ধানের শিষ, ধীরে ধীরে দুধ গাঢ় হচ্ছে। কোথাও ফাঁকে ফাঁকে কচুরিপানার ফুল ফুটেছে, তারাও শিশিরে ভেজা তখন। দুই–এক জায়গায় কাকতাড়ুয়া দাঁড়িয়ে আছে খেতের বুকে। দুই থেকে চার কৃষক, কেউ খেতের আলপথ ধরে হাঁটছেন, ঘুরে ঘুরে খেত দেখছেন। কেউ খেত থেকে ঘাস বেছে তুলছেন। গবাদিপশুর জন্য এই ঘাস বাড়ি নিয়ে যাবেন।

আমন ধানের খেত থেকে গবাদিপশুর জন্য ঘাস তুলে নিচ্ছেন এক কৃষক

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মল্লিকসরাই মাঠে কৃষক সুমন মিয়া গবাদিপশুর জন্য ঘাস তুলছিলেন। তিনি বলেন, নিজেরা খাওয়ার জন্য তাঁরা প্রায় পাঁচ কিয়ার (৩০ শতাংশ সমান ১ কিয়ার) জমিতে সুগন্ধি জাতের চিনিগুঁড়া ও বিরইন (বিন্নি) জাতের ধান চাষ করেছেন। তাঁর এক কিয়ার জমিতে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তবে বহুত (অনেক) মানুষ আছে দূরদূরান্ত থাকি আইয়া (থেকে এসে) ৩০ থেকে ৩৫ কিয়ারে অন্য জাতের ধান চাষ করছে। এবার ধান ভালা অইছে। কম খেত করি, খুব একটা লাভ নাই। আয়–ব্যয় প্রায় সমান।’

হাতে কাস্তে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন রজব আলী। তিনি এই মল্লিকসরাই এলাকায় ১৫ থেকে ১৬ বছর ধরে খেত করে আসছেন। এ বছর প্রায় চার কিয়ার জমিতে আমনের চাষ করেছেন। তাঁর এক কিয়ার জমিতে প্রায় আট হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ধান কাটার সময় আরও খরচ বাড়বে। তিনিও বলেন, এ বছর ভালো ধান হয়েছে। প্রতি কিয়ার জমিতে ১৭ থেকে ১৮ মণ ধান আশা করছেন। পোকা কিছু আক্রমণ করেছিল, ওষুধ দিয়েছেন। বড় সমস্যা হয়নি।

তবে রজব আলী বলেন, ‘আমরার খেতও ইঁদুরের আক্রমণ আছে। আগে ছিল না। দুই বছর ধরি ইঁদুরের আক্রমণ বাড়ছে। বড় সমস্যা অইল (হলো) ইঁদুর ধানগাছের গুড়িত (গোড়ায়) কাটিলায় (কেটে ফেলে)।’

ইঁদুরে ধানগাছ কাটার কথা জানালেন সাকিব মিয়াও। তাঁর কিছু জমির অংশ একেবারে কেটে তছনছ করে ফেলেছে। সাকিবের পরিবার প্রায় ১০ কিয়ার জমিতে আমন ধানের চাষ করেছে। তিনি বলেন, ‘ধান মোটামুটি ভালা অইছে।’

রাতের ঝরে পড়া শিশির জমে আছে ধানের পাতায়

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আমন ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। আমন ধানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৮ হাজার ২০ হেক্টর। এবার কৃষকেরা ব্রি–ধান ১০৩, ব্রি–ধান ৫১, ৫২ ও ৪৯ জাতের বেশি চাষ করেছেন। এ ছাড়া বন্যার পানি মোকাবিলা করতে সক্ষম ব্রি–ধান ২২ ও ২৩ জাতের ধান চাষ করেছেন অনেকে। এই সবুজ ধানের ভেতর এখন কুশি বেরিয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ, কাইচ থোড় বেরিয়েছে ৫০ শতাংশ, থোড় ৩২ শতাংশ ও ফুল বের হয়েছে ৯ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার আমন ধান কোনো দুর্যোগে পড়েনি। পোকার আক্রমণ তেমন ছিল না। পরিমিত ও দরকারি বৃষ্টি হয়েছে। খুব ভালো ধান হয়েছে।’