বৈষা দধির বিশেষত্ব হলো এটি মহিষের কাঁচা দুধ দিয়ে পাতা হয়
বৈষা দধির বিশেষত্ব হলো এটি মহিষের কাঁচা দুধ দিয়ে পাতা হয়

২০০ বছরের ঐতিহ্য নিয়ে ভোলার বৈষা দধি

ভোলার ভ্যাপসা গরম, দুপুর গড়াতে না গড়াতেই সদর রোডজুড়ে তীব্র যানজট নাগরিক জীবনকে ব্যস্ত করে ফেলে। গরমে হাঁসফাঁস করা মানুষ একটু স্বস্তি খোঁজে। আর সেই স্বস্তি এনে দিতে পারে ভোলার বিখ্যাত বৈষা দধি।

দুপুরের আগেই সব দোকানের হাঁড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। মহিষের কাঁচা দুধে পাতানো এই দই ভোলার স্বাদ, ইতিহাস ও গর্বের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ।

ভোলার দোকানগুলোতে প্রতিদিন মণকে মণ বৈষা দধি তৈরি হয়। এই দইয়ের বিশেষত্ব হলো, মহিষের কাঁচা দুধ দিয়ে এটি পাতা হয়। বাজারে সচরাচর যে দই পাওয়া যায়, সেসব তৈরি হয় গরুর দুধ দিয়ে এবং দুধ জ্বালিয়ে গাঢ় করে। কিন্তু ভোলার বৈষা দধি হয় মহিষের কাঁচা দুধ দিয়ে।

জলবেষ্টিত দ্বীপ জেলা ভোলার এক অমূল্য সম্পদ মহিষ। পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে তেঁতুলিয়া, উত্তরে ইলিশা আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর—এই চার নদী ও সমুদ্রবেষ্টিত চরাঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় হাজার হাজার মহিষ। সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা দেড় লাখের কাছাকাছি, তবে স্থানীয় লোকজনের মতে তা দুই লাখ ছাড়িয়েছে। এই মহিষের দুধই বৈষা দধির প্রাণ।

প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় থাকে এই দই। এ ছাড়া অতিথি আপ্যায়নের অন্যতম প্রধান উপাদান এটি। উৎসব-পার্বণ, বিয়েশাদি কিংবা যেকোনো সামাজিক আয়োজনে বৈষা দধি ছাড়া যেন ভোলার কোনো উৎসব পরিপূর্ণতা পায় না।

মুহাম্মদ শওকাত হোসেনের ‘ভোলা জেলার ইতিহাস’ বই থেকে জানা যায়, দুই শ বছর আগে থেকে ভোলায় চর জাগতে শুরু করে। বসতি হয়, মহিষ পালন শুরু হয়। দুধ সংরক্ষণের উপায় ছিল না বলে স্থানীয় বাসিন্দারা দই বানাতেন। সেখান থেকেই বৈষা দধির যাত্রা শুরু, যা পরে ছড়িয়ে পড়ে পুরো অঞ্চলে।

ভোলার মানুষের খাদ্যসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এই দই। এটি ভাতের সঙ্গে খাওয়া হয়, চিড়া-মুড়ির সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হয় মুখরোচক খাবার, আবার গরমের দিনে দই, পানি ও চিনি মিশিয়ে তৈরি করা হয় ঘোল—যা শরীরকে শীতল রাখে। শীতকালে হাঁসের মাংসের সঙ্গে টক দই ও খেজুরের গুড়—ভোলার ভোজনরসিকদের কাছে এক অনন্য স্বাদ। পান্তাভাতের সঙ্গে দই ও খেজুরের গুড় এই অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি খাবার।

বর্তমানে প্রতি কেজি বৈষা দই বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। তবে ঈদে দাম বেড়ে যায়। ঈদের আগেই বিক্রেতারা দুধ জমাতে শুরু করেন এবং এ সময়ে প্রতিদিন ৮০০–৯০০ কেজি পর্যন্ত দই বিক্রি হয়।

ভোলার দোকানগুলোতে প্রতিদিন মণকে মণ বৈষা দধি তৈরি হয়

শহরের গাজীপুর সড়কের আবদুস ছত্তার প্রায় ৪০ বছর ধরে মহিষের দুধ দিয়ে দই তৈরি করেন। তিনি বলেন, সারা বছরই তাদের দইয়ের চাহিদা থাকে। কিন্তু সব সময় চাহিদা অনুযায়ী দুধ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে দুধের জোগান কমে যায়। ফলে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী দুধ পাওয়া যায় না। এখন প্রতি কেজি দুধ কিনতে হয় ১৫০ টাকায়। আর তা থেকে দই তৈরি করে ২০০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করেন তাঁরা। এতে সামান্য লাভ হয়।

ভোলা লঞ্চঘাটে বেশ কয়েকটি কলসভর্তি মহিষের দুধ নিয়ে বাজারে যাচ্ছিলেন আজমল হোসেন নামে একজন ব্যাপারী। তিনি ভোলার শ্রীপুর থেকে নিজের বাথানের মহিষের দুধ ছাড়াও অন্য বাথান থেকে দুধ সংগ্রহ করে প্রতিদিন লঞ্চে ভোলা শহরে যান। তিনি ৩০ বছর ধরে এই কাজ করেন জানিয়ে বলেন, এখন দুধের জোগান কমে গেছে। যখন জোগান বেশি থাকে, তখন চার-পাঁচ মণ দুধ নিয়ে যান তিনি।

ভোলার মানুষের কাছে মহিষের দই মানে শৈশবের উৎসব, ঈদের সকালের মিষ্টি সুবাস, শীতের সন্ধ্যায় খেজুরের গুড়ের সঙ্গে স্বাদ মিশে যাওয়া স্মৃতি, ইতিহাস ও আবেগের এক অংশ।