
পায়রা নদের বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে। চুলার ভেতর পানি, তাই দুপুরে রান্না করতে পারেননি চম্পা বেগম। পানিতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় ছয় বছরের মেয়েকে তিনি তাঁর বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটাকে দেখার জন্য তাঁর মন আনচান করছে। কিন্তু বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে পারছেন না।
চম্পা বেগমের (৪০) বাড়ি পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার পায়রা নদের তীরবর্তী মেহেন্দিয়াবাদ গ্রামে। তাঁর স্বামীর নাম আবুল কালাম মল্লিক। তিনি পেশায় সবজি বিক্রেতা। এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তাঁদের পরিবার। পায়রা নদের তীরে ভাঙা বেড়িবাঁধের সামনে তাঁদের বসতঘর।
১৫ দিন আগে নিম্নচাপের প্রভাবে জোয়ারের পানির তোড়ে মেহেন্দিয়াবাদ গ্রামের মল্লিক বাড়ির সামনে প্রায় ২০০ মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ওই বেড়িবাঁধের মাত্র ২০ গজ সামনে চম্পা বেগমের বসতঘর। জোয়ারের সময় চম্পা বেগমের ঘরে পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয় আর ভাটিতে শুকায়। নির্ঘুম রাত কাটে তাঁদের। যেকোনো সময় তাঁর বসতঘরটি নদে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তবে বিকল্প না থাকায় সেখানে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন চম্পা বেগম ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
গত শুক্রবার বিকেলে মেহেন্দিয়াবাদ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি নেমে যাচ্ছে। চম্পা বেগমের টিনশেড ঘরে স্যাঁতসেঁতে মেঝে। তিনি ভাঙা বেড়িবাঁধের সামনে তাকিয়ে তাকিয়ে পায়রা নদের পানির স্রোত দেখছিলেন। এ সময় চম্পা বেগমের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে এই হান দিয়া একটু বানডা (বাঁধ) দিয়া দ্যান যেন পানি না ওডে। দুপুরে রানতে পারি নায়; চুলায় পানি ওঠছে। কয়েক দিন ধইরা খালি মানুষজন আসে আর ছবি তুইল্যা হাইট্টা যায়। কোনো কাম হয় না। ছয় বছরের আদরের মাইডারে ওর খালাবাড়ি পাডাইয়া দিছি ভাইস্যা যাওয়ার ডরে (ভয়ে)।’
চম্পা বেগম আরও বলেন, পায়রার ভাঙনে চারবার তাঁদের বাড়ি নদে গেছে। আর কোনো জমি নেই বাড়ি করার মতো। এই বাড়ি ভেঙে নদে গেলে কোথায় যাবেন, তাঁরা তা জানেন না। ছোট মেয়ে মারিয়াকে তার খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটি প্রতিদিন কান্না করে, মায়ের কাছে আসতে চায়; কিন্তু যেকোনো সময় তাঁদের বসতঘর ভেসে যেতে পারে। তাই তাকে বাড়িতে আনতে পারছেন না।
চম্পা বেগমের পাশেই লাকী বেগমের বসতঘর। তাঁদের অবস্থাও চম্পা বেগমদের মতো। বিকল্প না থাকায় ভাগ্যের ওপর ভরসা করে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন ভাঙনের মুখে।
একই এলাকার বাসিন্দা কবেদ আলী বলেন, ১৫ দিন আগে মল্লিকবাড়ির সামনে দিয়া বেড়িবাঁধের বড় একটি অংশ নদীতে ভেসে গেছে। বাঁধ মেরামত না করায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় মেহেন্দিয়াবাদ, চরখালী, রানীপুর গ্রাম। আতঙ্কে রাত কাটাতে হচ্ছে নদের তীরবর্তী বাসিন্দাদের।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন খান বলেন, নতুন বাঁধ নির্মাণের জন্য স্থানীয় লোকজন জায়গা দিতে চায় না। এ জন্য সমস্যা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে মির্জাগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, কয়েক দিন আগে মেহেন্দিয়াবাদ গ্রামের বেড়িবাঁধের প্রায় ২০০ মিটার ভেঙে গেছে। যেখান থেকে ভেঙেছে, তার একটু ভেতর দিয়ে বাঁধ দেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার এসেছিলেন। কিন্তু স্থানীয় লোকজন সেখান থেকে মাটি দিতে রাজি না হওয়ায় বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করে বাঁধ মেরামত করা হবে।
পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) মো. রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, জরুরি অবস্থায় বাঁধ নির্মাণ বা মেরামতের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাই স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সমন্বয় করেই বাঁধ নির্মাণ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে মেহেন্দিয়াবাদ-রাণীপুর গ্রামে বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য মাটির ব্যবস্থা করতে গিয়ে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।