
ভোরে রোজগারের আশায় ইজিবাইক নিয়ে বের হয়েছিলেন মোতালেব হোসেন (৪০)। দুপুর হওয়ার আগেই খবর এল—তিনি আর ফিরবেন না। ছয় সদস্যের পরিবারের একমাত্র ভরসা সেই মানুষটিকে হারিয়ে এখন স্তব্ধ নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের মুন্সিপাড়া গ্রাম। স্ত্রীর বুকফাটা কান্না আর ছোট তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারে।
আজ বুধবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে রংপুর–দিনাজপুর মহাসড়কের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী বাসস্ট্যান্ডে উল্টো পথে আসা বাসের চাপায় পড়ে প্রাণ হারান মোতালেব হোসেন। মোতালেব হোসেনের বাড়ি নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মুন্সিপাড়া গ্রামে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিনের মতো আজ ভোরে ইজিবাইক নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন মোতালেব হোসেন। ভোর পাঁচটার দিকে তারাগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে রংপুর–দিনাজপুর মহাসড়ক দিয়ে পাগলাপীর বাজারের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে ইজিবাইকটি মহাসড়কের ইকরচালী বাজারের কাছে পৌঁছালে দিনাজপুরগামী একটি মিনিবাস উল্টো পথে ঢুকে পড়ে। এতে মুখোমুখি সংঘর্ষে বাসচাপায় ঘটনাস্থলে মোতালেব মারা যান। দুই যাত্রী আহত হলে তাঁদের তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়। তারাগঞ্জ হাইওয়ে থানা–পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে মোতালেব হোসেনের লাশ পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যান।
দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আতিয়ার রহমান নামের স্থানীয় এক দোকানি বলেন, ‘আমার দোকানের সামনেই ঘটনা। সকালে দোকান খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি বাসটা বাঁ থেকে ডান দিকের লেনে হাই স্পিডে ঢুকে যায়। এ সময় ডান দিক থেকে আসা ইজিবাইকটি বাসের নিচে চাপা পড়ে যায়। ঘটনাস্থলে একজন মারা যান।’
পাশের আরেক দোকানমালিক জিয়াউর প্রামাণিক বলেন, শুধু আজ নয়, প্রায়ই বিভিন্ন গাড়ি উল্টো পাশ দিয়ে ওভারটেক করে এই স্ট্যান্ডে। এর আগেও এমন দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে অনেক মানুষের। কিন্তু এগুলো বন্ধ করার উপায় নেই।
নিহত মোতালেবের স্বজন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোতালেব হোসেনের কোনো আবাদি জমি নেই। বসতভিটার দুই শতক জমির ওপর ভাঙাচোরা দুটি টিনের ঘর ও ইজিবাইকটি ছিল তাঁর সম্বল। তাঁর তিন ছেলে–মেয়ে। এক মেয়ের বয়স ৪০ দিন। ছেলে শরীফ হোসেনের বয়স চার বছর ও মাসুম হোসেনের বয়স সাত বছর। মা–বাবাও থাকেন তাঁর সংসারে।
সকাল সাড়ে আটটার দিকে নিহত মোতালেব হোসেনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশের পরিবেশ। পুরো এলাকায় চলছে শোক। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মোতালেবের স্ত্রী মমতাজ বেগম।
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মমতাজ বলছিলেন, ‘আল্লাহ মুই কেমন করি বাঁচিম? মোর বাচ্চা তিনটাক যে মানুষ করার কোনো উপায় থাকিল না। ওমার পড়ার খরচ, খাওয়ার খরচ কোনটে পাইম? মরণের বাস মোর জাদু তিনটাক এতিম বানাইল। এ্যালা মুই কেমন করি বাঁচিম?’
মোতালেব হোসেনের মা ওলিমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রতিবেশীরা তাঁর মুখ ও মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফেরান। তারপরও কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বিলাপ করেন, ‘এ্যালা কায় হামাক দ্যাখপে, কায় মাও কয়া ডাকপে, মোর নাতি–নাতনিরা যে এতিম হয়া গেল। হামাক এ্যালা কায় খাওয়াইবে।’
প্রতিবেশী দুলাল হোসেন বলেন, মোতালেব হোসেনের সহায়সম্বল কিছু নেই। ইজিবাইক চালিয়ে তাঁর সংসার চলছিল। এক দিন গাড়ি নিয়ে বের না হলে স্ত্রী–সন্তানদের মুখে ভাত জোটে না। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির মৃত্যুতে পুরো পরিবার দিশাহারা হয়ে পড়েছে।
বাহাগিলি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সাদেকুল ইসলাম বলেন, মোতালেবের পরিবারের অবস্থা খুবই করুণ। তাঁর ছোট ছোট তিন ছেলে–মেয়ে। সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুতে পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেল। এমন মৃত্যু কখনোই কাম্য নয়।
তারাগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ইজিবাইকচালক মোতালেব হোসেনের লাশ উদ্ধার করেছি। দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ইজিবাইকটি ও মুরাদ পরিবহনের বাসটি জব্দ করা হয়েছে। বাসটি সড়ক থেকে সরিয়ে নিতে কাজ চলছে।’