
কুমিল্লার লালমাই পাহাড় এলাকার একটি টিলায় সম্প্রতি মাটি খনন করতে গিয়ে প্রাচীন স্থাপনার অস্তিত্ব খুঁজে পান এক ব্যক্তি। খবর পেয়ে জায়গাটিতে বর্তমানে খনন কার্যক্রম শুরু করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। গত কয়েক দিনের খননে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে প্রাচীন স্থাপনা ও প্রত্নবস্তু। আশা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে ইতিহাসের নতুন কোনো অধ্যায় উন্মোচিত হবে।
স্থানটি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বারপাড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধর্মপুর গ্রামের চারাবাড়ি এলাকার লালমাই পাহাড়ের একটি টিলার অংশ। গতকাল রোববার রাতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের (কুমিল্লা কার্যালয়) আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘জায়গাটি ব্যক্তিমালিকানাধীন। এক ব্যক্তি স্থাপনা নির্মাণের জন্য টিলার ওপরের অংশের মাটি খনন করতে গেলে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার অস্তিত্ব বেরিয়ে আসে। তবে পূর্ণাঙ্গ খনন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ নেই। তবে আমরা আশাবাদী, এখান থেকে নতুন কিছু পাব। এখনো আমরা পুরো কার্যক্রমের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। গুরুত্বসহকারে খননকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। বিস্তারিত খনন শেষে জানানো হবে।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন বলেন, এপ্রিলের শুরুতে জসিম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির বসতভিটা নির্মাণের জন্য মাটি খননের সময় লাল ইটের প্রাচীন স্থাপনাটি প্রথম দেখা যায়। এরপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কুমিল্লা আঞ্চলিক কার্যালয়ের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং খনন ও অনুসন্ধান শুরু করে। তাদের ধারণা, এটি কোনো জমিদার বা রাজ পরিবারের বাসস্থান অথবা তাদের কোনো স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ হতে পারে।
জসিম উদ্দিন বলেন, মাটি সমান করার সময় শ্রমিকদের কোদালের কোপে শক্ত ইটের গাঁথুনির বিষয়টি টের পাওয়া যায়। পরে একটু খুঁড়ে দেখা গেছে, প্রাচীন আমলের ইটের স্থাপনা। এমন ইট কুমিল্লা কোটবাড়ী শালবন বিহারে দেখা যায়। এরপর বিষয়টি জানতে পেরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের লোকজন খননের সিদ্ধান্ত নেন। যদি নতুন কোনো প্রত্ন স্থাপনা পাওয়া যায়, তাহলে এটি হবে আনন্দের সংবাদ।
স্থানীয় বারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য এবং ধর্মপুর গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই, এখানকার সব নিদর্শন সংরক্ষণ করা হোক। সেই সঙ্গে প্রকৃত ইতিহাস বের হয়ে আসুক।’
স্থানটিতে খননকাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের (কুমিল্লা কার্যালয়) মাঠ কর্মকর্তা (ফিল্ড অফিসার) আবু সাইদ ইনাম। তিনি বলেন, পুরো জায়গাটা কতটুকু হবে বা কত শতাব্দীর, এগুলো এখনো বলা যাচ্ছে না। পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য খনন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ছয় মিটার আকারে পাঁচটি জায়গায় আপাতত খননের কাজ চলছে। এরই মধ্যে অনেক প্রত্নবস্তু ও ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে।
স্থানটি এখন সংরক্ষিত পুরাকীর্তি জানিয়ে আবু সাইদ বলেন, ‘গত ১০ এপ্রিল থেকে আমরা খনন কাজ শুরু করেছি। এলাকাটি বেশ বড়ই হবে মনে হচ্ছে। ধারণা করছি, এখনো বড় ধরনের স্থাপনা আছে। প্রতিদিন আমাদের ২০ জনের মতো শ্রমিক যত্ন নিয়ে খননকাজ করছেন।’
প্রত্নস্থাপনাটির ইটের অস্তিত্ব দেখে কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবির ধারণা করছেন, এটি সপ্তম শতাব্দীর পরবর্তী সময়ের কোনো স্থাপনা। ধর্মপুর এলাকার আশপাশে রাজ পরিবার ও জমিদারদের বসবাস ছিল।
আহসানুল কবিরের মতে, ধর্মপুরের এই প্রত্নস্থান ইতিহাসের জন্য নতুন চাবিকাঠি হতে পারে। এখন পর্যন্ত শালবন বিহারই অঞ্চলটির সবচেয়ে পুরোনো স্থাপনা। শালবন বিহার যেই পাহাড়ি এলাকায়, ঠিক একই পাহাড়ের মধ্যে উন্মোচিত হতে যাওয়া এই প্রত্নস্থানের অবস্থান। শালবন বিহারের যে ইট, সেটির সঙ্গে এই প্রত্নস্থানে পাওয়া ইটেরও বেশ মিল দেখা যাচ্ছে। অনুমান করা যাচ্ছে, এই স্থাপনা সপ্তম শতাব্দী পরবর্তী সময়ের। সব মিলিয়ে এখানে ইতিহাসের নতুন কোনো চাবিকাঠি থাকার জোর সম্ভাবনা আছে।