রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ভবন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ভবন

কর্মবিরতিতে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম ও অফিসার্স সমিতি, শঙ্কায় রাকসু নির্বাচন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শিক্ষকদের ‘লাঞ্ছিত’ করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষাসহ সব কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম ও অফিসার্স সমিতি। আজ রোববার সন্ধ্যায় শিক্ষক ফোরাম এক বিজ্ঞপ্তিতে ও অফিসার্স সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেয়।

এদিকে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি (কমপ্লিট শাটডাউন) ঘোষণা করায় আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও আজ বিকেলে রাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা বৈঠকের পর জানিয়েছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে তাঁরা যথাসময়ে নির্বাচন করতে চান। এরপরও তাঁরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রার্থীরাও নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল আলীম ও সাধারণ সম্পাদক মো. আমীরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের জরুরি সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হলো—সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ অন্য শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়, শিক্ষকদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে আগামীকাল সোমবার বেলা ১১টায় একটি মানববন্ধন কর্মসূচি করা হবে এবং জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষাসহ সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মবিরতি। রোববার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের পাশে

শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে রাকসু নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক আব্দুল আলীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাকসু নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার। সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই। আমরা আমাদের বিষয় নিয়ে কথা বলছি। রাকসু স্বাধীন কমিশন। রাকসুর বিষয় নিয়ে আমরা কোনো বক্তব্য দেব না। রাকসু নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।’

এদিকে আজ সন্ধ্যায় জুবেরী ভবনে সংবাদ সম্মেলন করেছে অফিসার্স সমিতি। সমিতির সভাপতি মোক্তার হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও কর্মকর্তাদের ন্যক্কারজনক হেনস্তার ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃশ্যমান বিচার কার্যকর করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার আওতায় আনতে হবে। দুটি দাবি দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় “কমপ্লিট শাটডাউন” থাকবে। তবে চিকিৎসা, পানি, বিদ্যুৎসহ জরুরি সেবা এই কর্মসূচির আওতার বাইরে থাকবে।’

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মসূচির কারণে রাকসু নির্বাচনে ব্যাঘাত ঘটবে কি না প্রশ্ন করলে মোক্তার হোসেন বলেন, ‘এই কর্মসূচির কারণে রাকসুতে কিঞ্চিৎ ব্যাঘাত ঘটলে সেই ব্যর্থতা প্রশাসনের, আমাদের না। তবে আমরা চাই উৎসবমুখর পরিবেশে রাকসু হোক। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থাকবে। ছুটির দিন আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই।’

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে নির্বাচন কমিশন

পোষ্য কোটা নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছে রাকসু নির্বাচন কমিশন। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক সভা শেষে সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বর্তমান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ণাঙ্গ কমিশন আজ বৈঠকে বসে এবং পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে। আমাদের যে কার্যক্রম আছে, সেগুলো চলমান আছে। ২৫ তারিখের যে নির্ধারিত তারিখ ঠিক করা আছে, সেটাকে ধরেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি। আপনারা জানেন, আমাদের সব কর্মকাণ্ড প্রায় শেষ পর্যায়ে।’

অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, ‘আমরা কমিশনে বসে পর্যালোচনা করেছি। আমরা আরও দেখব। যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে, ২৫ তারিখে ভোট হবে। এই সিদ্ধান্তই কমিশনে আমরা অব্যাহত রেখেছি। আবারও আমি বলছি, ২৫ তারিখে ভোট পেছানোর কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করে নাই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সব গুছিয়ে এনেছি। উৎসবের শেষের দিকে এসে এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা আশা করি না। কারণ, শিক্ষার্থীদেরই হাতে এই রাকসু তুলে দেওয়ার জন্য আমরা বিগত দিনগুলোতে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে রাকসুর এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন। আমরা তাদের পোলিং অফিসার করেছি। আগামীকাল দিনব্যাপী ওয়ার্কশপ, নির্বাচন কমিশন এটা পরিচালনা করার কথা ছিল, সেটি তাহলে ছেদ ঘটবে। আমরা তো একটু ধাক্কা খেলাম।’

অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত আছি যেন সবাইকে নিয়ে রাকসুটা আগের যে শিডিউল, সেই মোতাবেক থাকে। পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই আপনাদের সঙ্গে কথা বলব।’

যা বলছেন প্রার্থীরা

এদিকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রার্থীরা। তাঁরা মনে করছেন, নির্বাচনের অন্যতম অংশীজন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সহযোগিতা না করলে নির্বাচন করাটা কঠিন হয়ে উঠবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না বলেও তাঁরা মনে করছেন।

‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’ প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি চলে গেছেন। আর পোষ্য কোটা নিয়ে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’

ছাত্রদল–সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন আবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পোষ্য কোটা বাতিলের পক্ষে এবং ২৫ সেপ্টেম্বরই নির্বাচন চাই। কিন্তু গুটিকয় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী বেশি তৎপর, তারাই নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র করছে। এই পরিস্থিতিতে ঝড়ঝাপটা বেড়ে গেছে। হলে হলে খোঁজ নিয়ে দেখেন, অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি চলে গেছেন। এই মুহূর্তে জানি না, নির্বাচন হবে কি না। তবে আমি নির্বাচন না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি দেখছি।’

ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান (জাহিদ) বলেন, ‘পোষ্য কোটা বাতিল ও ২৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের দাবিতে আমরা অনড় আছি। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা দেখছি। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি নির্বাচনে সহযোগিতা না করেন, তাহলে এটা কষ্টকর হবে। গতকালের ঘটনায় সব প্যানেলের প্রচার-প্রচারণায় ভাটা পড়েছে। অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি চলে গেছেন। প্রশাসনের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই উৎসবমুখর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এ জন্য প্রশাসনকে শিক্ষার্থীদের পালস বুঝে কাজ করতে হবে।’

গত বৃহস্পতিবার প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ১০টি শর্তে পোষ্য কোটা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। উপাচার্যের দায়িত্বে নিযুক্ত সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীনের সভাপতিত্বে সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত ভর্তি উপকমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপরই ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার বিক্ষোভের পর সন্ধ্যায় পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে অনশনে বসেন কয়েকজন শিক্ষার্থী।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবন প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল শনিবার বিকেলে

গতকাল শনিবার বিকেলে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রশাসন ভবন থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা তাঁকে আটকে বিক্ষোভ করেন। পরে তিনি গাড়ি থেকে নেমে বাসভবনের দিকে গেলে শিক্ষার্থীরা তাঁর বাসভবনে তালা দেন। পরে সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের দিকে যান। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাঁদের জুবেরী ভবনে ঢুকতে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। এরপর সহ-উপাচার্যসহ কর্মকর্তাদের জুবেরী ভবনে আটকে রেখে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। এরপর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাত একটার দিকে উপাচার্য মৌখিকভাবে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন।

এ ঘটনায় আজ বিকেলে উপাচার্যের বাসভবনে সিন্ডিকেটের জরুরি সভা হয়। সভায় পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত স্থগিতের সিদ্ধান্তসহ গতকালের ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম ও অফিসার্স সমিতি সভা করে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়।