
এপ্রিল মাসে ‘ইনমা’র প্রধান কার্যালয় থেকে আমার কাছে ফোনকল আসে। ইনমা—ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন। বিশ্বের বৃহত্তম মিডিয়া সংগঠন। ১০০টির বেশি দেশের আট শতাধিক সেরা সংবাদমাধ্যম এর সদস্য। তাঁরা আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন, আমি যেন নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক মিডিয়া কংগ্রেসে যোগ দিই। তা থেকে আমাদের একটা ধারণা হয় যে প্রথম আলো হয়তো এবার ভালো একটা পুরস্কার পেতে পারে।
সংবাদমাধ্যমের বিশ্বমঞ্চে
২১ মে তিন দিনের সম্মেলন শুরু হয় বিশ্বখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস–এর সম্মেলন কেন্দ্রে। আর ২২ মে, ২০২৫ নিউইয়র্কের ম্যানহাটানে এডিসন হোটেলের বলরুমে গণমাধ্যমের বিশ্ব কংগ্রেসে হাজির হয়েছি। আমার সঙ্গে আছেন প্রথম আলোর মহাব্যবস্থাপক ও হেড অব মার্কেটিং মো. আজওয়াজ খান। রাত নয়টার দিকে পুরস্কার দেওয়া শুরু হলো। তারপর একসময় মঞ্চ থেকে ‘বেস্ট আইডিয়া টু এনকারেজ রিডার এনগেজমেন্ট’ শ্রেণি বা ক্যাটাগরিতে (ন্যাশনাল ব্র্যান্ড) পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা এল। এই ক্যাটাগরিতেই প্রথম আলোর মনোনয়ন আছে। আমরা আগ্রহ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছি।
মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো, তৃতীয় পুরস্কার পাচ্ছে নরওয়ের বিখ্যাত শিবস্ট্যাড মিডিয়া। পেরুর বড় পত্রিকা এল কমার্সিও গ্রুপ দ্বিতীয়। এবার প্রথম পুরস্কার।
মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হলো, এটি পাচ্ছে প্রথম আলো, বাংলাদেশ থেকে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সাহসী সাংবাদিকতা, তরুণ পাঠকদের যুক্ততা ও পরবর্তী নানামুখী উদ্যোগের জন্য এই পুরস্কার পাচ্ছে প্রথম আলো। মঞ্চে উঠে পুরস্কার গ্রহণ করলাম। সাহসী উদ্যোগে প্রাপ্য পুরস্কার প্রাপ্তি প্রথম আলোর জন্য সত্যিই অনেক আনন্দের। আরও পুরস্কার ঘোষণা করা হচ্ছে। মঞ্চের দিকে আর বড় পর্দায় চোখ রাখছি; কারণ, সারা পৃথিবীর সেরা গণমাধ্যমগুলো কী কী নতুন কাজ করে পুরস্কার জিতে নিচ্ছে, তা থেকে নতুন নতুন ভাবনা পাওয়া যায়। আমরা কোথায় ভালো করছি, কোথায় পিছিয়ে আছি, তা–ও জানতে পারি। নিউজ ব্র্যান্ডের আরেকটি পুরস্কারের ঘোষণা করা হলো ‘বেস্ট ইউজ অব অ্যান ইভেন্ট টু বিল্ড এ নিউজ ব্র্যান্ড’ ক্যাটাগরিতে। আমাদের ‘জাতীয় স্বাস্থ্য অলিম্পিয়াড’ উদ্যোগের জন্য তৃতীয় পুরস্কার পেল প্রথম আলো। এই উদ্যোগে আমাদের সঙ্গে ছিল আইসিডিডিআরবি। এই শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং দ্বিতীয় হয়েছে ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস। এভাবে মোট ২০টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হলো। বিশ্বের প্রধান পত্রিকাগুলোর যারা এবার পুরস্কার পেয়েছে, তারা হলো যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ডেইলি মেইল, যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, ভারতের দি টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, কানাডার টরেন্টো স্টার, হংকংয়ের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট প্রভৃতি।
প্রথম আলো বৈশ্বিক এই প্রতিযোগিতায় আগেও সাফল্য পেয়েছে। ৫ বছর ধরে প্রথম আলো এই সম্মানজনক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আসছে এবং এর আগে একবার প্রথম আলো প্রথম পুরস্কার অর্জনসহ মোট ১১টি পুরস্কার পেয়েছে। তবে সব পুরস্কার ছাপিয়ে গেছে এবারের এই স্বীকৃতি—যেখানে প্রথম পুরস্কারের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো অর্জন করেছে ‘দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা’র স্বীকৃতি।
আকর্ষণীয় ছয় পুরস্কার
সবশেষে আরও আকর্ষণীয় ছয়টি পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের ছয়টি অঞ্চলের ছয়টি সেরা সংবাদমাধ্যমের উদ্যোগকে সেরার স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়ার পালা। যার মধ্যে ইউরোপ, আফ্রিকা, লাটিন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, এশিয়া প্যাসিফিকও সেরার স্বীকৃতি ও সম্মান পেল। আমি টেবিলে বসে ভাবছি, দক্ষিণ এশিয়ার এই ক্যাটাগরিতে যদি আমরা সেরার পুরস্কারটা জিতে নিতে পারতাম, কেমন হতো! কিন্তু সে রকম কোনো আভাস তো আগে পাইনি। কাজেই কে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা, তা শোনার জন্যই তাকিয়ে রইলাম মঞ্চের দিকে। আমাদের জন্য এল এক আনন্দদায়ক ও বিস্ময়কর মুহূর্ত। ঘোষণা হলো, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা প্রথম আলো। চারদিকে তুমুল করতালি। আলোকিত মঞ্চে উঠে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পুরস্কার গ্রহণ করলাম।
ইনমা গ্লোবাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডসে বাংলাদেশ থেকে এর আগে ‘দক্ষিণ এশিয়ার সেরা’ স্বীকৃতি তো নয়ই, এমনকি কোনো ক্যাটাগরিতেই প্রথম পুরস্কার পায়নি বাংলাদেশি কোনো সংবাদমাধ্যম।
কেন ‘সেরা’র পুরস্কার
একটা ক্যাটাগরিতে প্রথম আলো বিশ্বের সেরা পুরস্কার পেয়েছে, আর সার্বিকভাবে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সেরার সম্মান পেয়েছি, শুধু এই কারণে এবারের পুরস্কারটা আমাদের জন্য নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে আমাদের কাছে এবারের পুরস্কারের গুরুত্ব হলো কোন, বিষয়ে সাংবাদিকতার কাজ করার জন্য আমরা স্বীকৃতিটা পেলাম? গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই বিষয়ে প্রথম আলোর ভূমিকা থেকেই এই স্বীকৃতিটা এসেছে। গণ–আন্দোলনের দিনগুলোতে সাহসের সঙ্গে, পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে, নির্ভুলভাবে সত্য অনুসন্ধান করা এবং সত্য প্রকাশ করার স্বীকৃতি এটা।
আমি টেবিলে বসে ভাবছি, দক্ষিণ এশিয়ার এই ক্যাটাগরিতে যদি আমরা সেরার পুরস্কারটা জিতে নিতে পারতাম, কেমন হতো! কিন্তু সে রকম কোনো আভাস তো আগে পাইনি। কাজেই কে হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা, তা শোনার জন্যই তাকিয়ে রইলাম মঞ্চের দিকে। আমাদের জন্য এল এক আনন্দদায়ক ও বিস্ময়কর মুহূর্ত। ঘোষণা হলো, দক্ষিণ এশিয়ার সেরা প্রথম আলো।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
প্রায় ১৬ বছর ধরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে স্বৈরাচারী কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন আমাদের ওপর চেপে বসেছিল, সেই সময় প্রচণ্ড দমন-নিপীড়নের কারণে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশ করা, সাংবাদিকতা করা বিপজ্জনক এবং কঠিন হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে প্রথম আলো ছিল তখনকার স্বৈরাচারী সরকারের এক নম্বর টার্গেট। তখনকার প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং সরকারের অন্যান্য নেতা সংসদের ভেতরে–বাইরে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে বিষোদ্গার করেছেন। সংসদে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন,‘ স্বনামধন্য এক পত্রিকা। খুবই পপুলার। নাম তার প্রথম আলো। কিন্তু বাস করে অন্ধকারে। প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু।’ (১০ এপ্রিল, সোমবার, ২০২৩)।
স্বৈরাচারের নিষ্পেষণ
প্রথম আলোর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা করা হয়েছে। একটা সময় আমার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ষাটের অধিক। প্রথম আলোর প্রচারসংখ্যা কমানোর জন্য নানা রকম চেষ্টা করা হয়েছিল। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রথম আলো রাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারি আয়োজনে নিষিদ্ধ ছিলেন প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা। সরকারি বিজ্ঞাপন তো প্রায় বন্ধ ছিলই। বেসরকারি ৪৯টির বেশি বড় প্রতিষ্ঠানকে আদেশ করা হয়েছিল যেন তারা প্রথম আলোকে বিজ্ঞাপন না দেয়। এরপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করা হয়েছিল প্রথম আলোর সম্পাদক বদল এবং সবশেষে মালিকানা বদলের জন্য।
এ রকম শ্বাসরোধী স্টিমরোলারে পিষ্ট হওয়ার মতো প্রচণ্ড চাপ থেকে মুক্তির জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে দেশের কোটি কোটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এক বিন্দুতে এসে মিলে গিয়েছিল। সে সময় আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, যত চাপ আসুক না কেন, সত্য প্রকাশে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব। আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহ আমরা সংবাদ, ছবি, ভিডিও-সমেত ছাপা পত্রিকা ও ডিজিটাল মিডিয়ায় বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছি। সেই সঙ্গে আন্দোলনে আহত, নিহত, শহীদদের তথ্য, তাঁদের পরিবারের মানবিক কাহিনি আমরা প্রতিটি ঘটনা ধরে, যাচাই-বাছাই করে, নির্ভুলভাবে প্রকাশ করে গেছি। প্রথম আলো শহীদদের যে সংখ্যা, তালিকা প্রকাশ করেছে, আজ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পরও দেখা যাচ্ছে, সেটাই সবচেয়ে সঠিক তালিকা ছিল। এই তথ্যগুলো প্রথম আলোর বিশেষ ওয়েবসাইট জুলাই গণ-অভ্যুত্থান july36.prothomalo.com–এ আছে।
নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যম
আমাদের সংবাদগুলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংবাদ হিসেবে মানুষ গ্রহণ করেছে। আমাদের ফটোসাংবাদিকদের আন্দোলনের ছবিগুলো ভাইরাল হয়েছে, আন্দোলনকারীদের উদ্দীপিত করেছে। আন্দোলন, নিপীড়ন, প্রতিরোধ, গুলি, হতাহত, স্বজন-হারানো পরিবারগুলোর ওপর আমাদের লেখা, ছবি এবং ভিডিও-সংবাদ মানুষকে সাহসী করে তুলছিল। এই সময় সঠিক তথ্য জানার জন্য মানুষ প্রথম আলো পত্রিকা আর প্রথম আলো অনলাইন ব্যাপকভাবে পড়ছিলেন। প্রথম আলো ছাপা পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বেড়েছিল দেড় লাখের মতো। আর জুলাই অভ্যুত্থানের ৩৬ দিনে প্রথম আলো ডটকমের পেজ ভিউ বেড়ে হয়েছিল ৩১ কোটি। আর আগস্ট পুরোটা ধরলে এই সংখ্যা ৩৫ কোটি। এর মধ্যে তরুণদের সংখ্যা ছিল ৪৩ শতাংশ। ইংরেজি পোর্টালে পড়েছেন ৩৫ লাখ পাঠক। আমাদের সামাজিক মাধ্যমে যুক্ত হয়েছেন ৭ কোটি ৪০ লাখ পাঠক।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সংবাদমাধ্যম নিয়ে জরিপ করেছে। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ছাপা পত্রিকা ও অনলাইন মিলিয়ে সংবাদপত্র পাঠকদের ৫৭ শতাংশ প্রথম আলো পড়ে থাকেন। আসলে প্রথম আলোর শক্তির উৎস আমাদের এই বিপুলসংখ্যক পাঠক।
প্রথম আলো শুধু খবর, ছবি, ভিডিও প্রকাশ ও প্রচার করেই থেমে থাকেনি। অভ্যুত্থানের পর প্রথম আলো সারা দেশের আন্দোলনে সক্রিয় মানুষদের কাছ থেকে আহ্বান করে আন্দোলনের ছবি আর ভিডিও। প্রচুরসংখ্যক ছবি আর ভিডিও জমা পড়ে। সেসব থেকে বাছাই করে সেরা ১০ ছবি আর সেরা ১০ ভিডিওকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
জুলাই উদ্যাপনে
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ৪ নভেম্বর ২০২৪-এর সব কার্যক্রমের মূল থিম হিসেবে নেওয়া হয় ২০২৪-এর গণ–অভ্যুত্থানকে। এ উপলক্ষে নির্মাণ করা হয় বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র ‘বিদ্রোহে– বিপ্লবে’। প্রামাণ্যচিত্রটি এখন পর্যন্ত ভিউ হয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখের অধিক। পাশাপাশি ১০টি টিভি চ্যানেলেও এই প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। প্রথম আলো অনেকগুলো ক্রোড়পত্র বের করে জুলাই বিপ্লবের পর। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষেও চারটি ক্রোড়পত্রের বিষয় ছিল গণ–অভ্যুত্থান। বিভাগ ধরে ধরে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা থেকেও প্রকাশ করা হয় ক্রোড়পত্র। দুটি বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রকাশ করা হয়েছে। একটি আন্দোলনের সময় মোহাম্মদপুর এলাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে; আরেকটি ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনার পতনের পরে সাভার এলাকায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে। এ দুটি প্রামাণ্যচিত্রেরও ভিউ ছাড়িয়েছে ৬০ লাখের বেশি। গণ–আন্দোলনকে উপজীব্য করে প্রথমা থেকে প্রকাশ করা হয়েছে ছয়টি বিশেষ বই। আরেকটি বিশেষ আয়োজন করেছিল জুলাই জাগরণ প্রদর্শনী। শিল্পকলা একাডেমি এ আয়োজনে সহযোগিতা করেছিল। তাতে আন্দোলনের সময় প্রথম আলোর খবর, ছবি, ভিডিওর পাশাপাশি শহীদদের স্মারক উপস্থাপন করা হয়। যেখানে শহীদ পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। অনেক মানুষ এই প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন।
প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ৪ নভেম্বর ২০২৪-এর সব কার্যক্রমের মূল থিম হিসেবে নেওয়া হয় ২০২৪-এর গণ–অভ্যুত্থানকে। এ উপলক্ষে নির্মাণ করা হয় বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র ‘বিদ্রোহে– বিপ্লবে’।
এখানে একটা কথা বলা বিশেষভাবে দরকার। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে সারা পৃথিবীর সব গণতন্ত্রকামী মানুষেরই বিশেষ রকমের আগ্রহ ছিল। এখনো আছে। দেশের ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে নিরস্ত্র জনতা আন্দোলন করে বুকের রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে একটা কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী সরকারকে হটিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীর মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে এই আন্দোলনকে দেখে, এ সম্পর্কে জানতে চায়। পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ দেশে দেশে এই আন্দোলন থেকে প্রেরণা নিতে চায়। এই আন্দোলন–অভ্যুত্থানের সংবাদ আমরা ভালোভাবে প্রকাশ করেছি। পাঠক আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এ জন্যই আমরা এই পুরস্কার পেয়েছি। এই স্বীকৃতির উপলক্ষটা, এর উদ্যাপন, এর আনন্দ আমরা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। আমাদের সব পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা, সবার সঙ্গে, আপনাদের সঙ্গে। আর বিশেষ করে স্মরণ করছি জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সব শহীদকে, সব আহত যোদ্ধা, সব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে। আমরা শুভেচ্ছা জানাই জুলাই গণ-আন্দোলনের নেতাদের, কারিগরদের এবং বাংলাদেশের কোটি জনতাকে।
প্রথম আলো টিকে থাকল কী করে
একটা প্রশ্ন আসে। স্বৈরাচারী সরকারের প্রচণ্ড দমন-নিপীড়ন, অত্যাচার–নির্যাতনের মুখে প্রথম আলো টিকে থাকল কী করে? ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম প্রকাশের দিন থেকে আজ ২৭ বছর প্রায় সব সরকারের আমলেই প্রথম আলো সরকারি চাপ ও বাধার মুখে পড়েছে। দুবার বিএনপি সরকার এবং দীর্ঘদিনের আওয়ামী লীগ সরকার, এমনকি ২০০৬-২০০৮–এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও প্রথম আলোর ওপর সরকারি চাপ কম ছিল না। এখন হয়তো সরকারের দিক থেকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা চাপ প্রয়োগের ঘটনা নেই, কিন্তু সরকারের বাইরেও দেশে-বিদেশে নানা মহল, এর মধ্যে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমও আছে। নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অব্যাহত আক্রমণের পরও প্রথম আলোর স্বাধীন সাংবাদিকতা অব্যাহত রয়েছে। প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে সাত দিন ধরে জমায়েত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়েছে। এত কিছুর মধ্যেও প্রথম আলো টিকে থাকে, সামনে এগোয় কীভাবে?
প্রথম আলো শুধু প্রথম আলোর সাংবাদিক বা কর্মীদের পত্রিকা নয়, প্রথম আলো হলো বাংলাদেশের কোটি মানুষের মুখপত্র, মানুষের আস্থা আমাদের ওপর রয়েছে। আমরা জানি, ইতিহাস বলে, মানুষের পরাজয় নেই।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সংবাদমাধ্যম নিয়ে জরিপ করেছে। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ছাপা পত্রিকা ও অনলাইন মিলিয়ে সংবাদপত্র পাঠকদের ৫৭ শতাংশ প্রথম আলো পড়ে থাকেন। আসলে প্রথম আলোর শক্তির উৎস আমাদের এই বিপুলসংখ্যক পাঠক। পাঠকের এই ভালোবাসা প্রথম আলো পায় তার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, সৎ, সাহসী, স্বাধীন, দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার জন্য।
প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান শুরুর দিনগুলোতে বলেছিলেন, ১. প্রথম আলোকে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ থাকতে হবে। ২. প্রথম আলোকে এক নম্বর কাগজ হতে হবে। ৩. প্রথম আলোকে নিজের আয়ে চলতে হবে। নিজের আয়ে যদি কাগজ চলতে না পারে, তাহলে সেই কাগজ স্বাধীন নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করতে পারে না। আমরা এই তিনটা শর্ত পূরণ করার চেষ্টা সব সময় করে যাই। আর আমরা দেশের সব আইনকানুন মান্য করি, প্রতিষ্ঠান এবং কর্মীরা নিয়মিত ট্যাক্স-ভ্যাট দিয়ে থাকি। আমরা বাংলাদেশের মিডিয়ায় সেরা করদাতা।
সে কারণেই শত আঘাত, শত বাধা, শত নিপীড়নেও প্রথম আলো মাথা নিচু করে না। প্রথম আলো এখনো এই তিন সূত্র মেনে চলে, চলবে। স্বাধীন থাকব, বস্তুনিষ্ঠ থাকব, আমরা সৎ সাংবাদিকতা করে যাব পেশাদারির সঙ্গে এবং কোনো অন্যায়ের কাছে আমরা মাথা নিচু করব না।
প্রথম আলো শুধু প্রথম আলোর সাংবাদিক বা কর্মীদের পত্রিকা নয়, প্রথম আলো হলো বাংলাদেশের কোটি মানুষের মুখপত্র, মানুষের আস্থা আমাদের ওপর রয়েছে। আমরা জানি, ইতিহাস বলে, মানুষের পরাজয় নেই।