Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে বহু মানুষের প্রিয়জনকে। অদেখা এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের ভয়ে যখন অনেকে আপনজনের কাছ থেকে দূরে সরে গেছেন, সে সময় এমন ভালোবাসা নিয়েও প্রিয়জনের পাশে গেছেন অনেকে

লকডাউন শুরুর সেই দিনগুলো কেমন ছিল

চার বছর আগের এই দিনে শুধু সময়ের নয়, পরিবেশ-পরিস্থিতিতেও ছিল আকাশ-পাতাল পার্থক্য। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হয়েছিল। পুরো দেশের মানুষ ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কের পাশাপাশি জীবন-জীবিকা নিয়েও অনিশ্চয়তায় পড়তে হয়। মুক্তজীবন থেকে সবাই হয়ে পড়েছিল ঘরবন্দী। এই সময়ে এমন অনেক কিছুই হয়েছে যা আগে কখনো দেখেনি বাংলাদেশ। সেসব অভিজ্ঞতা চাইলেও ভোলা সম্ভব নয়।

‘কোয়ারেন্টিন’, ‘লকডাউন’, ‘হোম অফিস’, ‘অনলাইন ক্লাস’ ও ‘নিউ নরমাল’-এর মতো নতুন নতুন শব্দ যুক্ত হয়ে যায় প্রতিদিনকার নাগরিক জীবনে। করোনার লকডাউনে রাস্তাঘাট, হাটবাজার অনেকটাই জনশূন্য হয়ে পড়ে। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন ছুটি থাকার পর ৩১ মে সীমিত আকারে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ও কলকারখানা খুলে দেওয়া হয়। তবে এরপর কয়েক ধাপে সংক্রমণ বাড়ায় সীমিত, কঠোর, সর্বাত্মকের মতো ভিন্ন নাম ও ধরনের লকডাউনের মুখোমুখি হতে হয় দেশের মানুষকে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, অতীতে কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়ার মহামারি আসত, দু-এক মাস থাকার পর বিদায় নিত। কিন্তু এভাবে ধনী-গরিব, প্রভাবশালী-সাধারণ, শহর-গ্রাম মিলে সব মানুষের জীবনে করোনার মতো প্রভাব ফেলার ঘটনা বিরল।

লকডাউনের দিনগুলো কেমন ছিল জানতে চাই আন্তর্জাতিক একটি উন্নয়ন সংস্থায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ইমতিয়াজ হকের কাছে। তিনি বলেন, করোনা নিয়ে ভয়-আতঙ্ক ছিল তীব্র। লকডাউনের কারণে এক নতুন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কর্মস্থল হয়ে পড়ে ল্যাপটপ-মোবাইলের মধ্যে সীমিত। তবে চার দেয়ালের ভেতরে আটকা পড়া সে সময়ে পরিবার বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল।

করোনায় লকডাউনের মধ্যে কাজ হারিয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে এভাবে গ্রামে ফিরে যেতে হয় বহু মানুষকে

লকডাউনে সবার অভিজ্ঞতা এক রকম ছিল না। বিশেষ করে দিনমজুর, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, পরিবহনশ্রমিকদের কষ্টের মধ্যে দিন পার করতে হয়। কাজ হারিয়ে অনেকেই পরিবার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। শহর ছেড়ে অনেকে গ্রামে ফিরে যান। জামালপুরের বকশীগঞ্জে বাড়ি সোহেল সরকারের। ঢাকায় রিকশা চালান। করোনার লকডাউনের পুরো সময় গ্রামে ছিলেন। সেই সময়ের কথা স্মরণ করে সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘হুট করে সব বন্ধ হয়ে গেল। বাবা-মা, স্ত্রী, দুই ছেলেসহ পরিবারে ছয়জন। খুব কষ্ট হইছে করোনার সময়ে।’

বিশ্বে করোনাভাইরাসে প্রথম মৃত্যু ঘটেছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে। করোনাভাইরাস শনাক্তে বাংলাদেশে পরীক্ষা শুরু হয় ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে। বেশ কিছু দিন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে কাটানোর পর সে বছরের ৮ মার্চ সরকার প্রথম দেশে করোনা শনাক্তের কথা জানায়।

করোনার মধ্যে দীর্ঘদিন এমন ফাঁকা ছিল ঢাকার সড়ক, যা আগে কখনো দেখেননি রাজধানীর বাসিন্দারা 

দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ। রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগ এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করা হয় ২৩ মার্চ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্য বেসরকারি প্রশাসনকে সহায়তা দিতে মাঠে নেমেছিল সেনাবাহিনীও।

যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল অঙ্গরাজ্যের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশন জানিয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম দুই বছর বাংলাদেশে স্বাভাবিক বছরগুলোর তুলনায় ৩ লাখ ৩২ হাজার বেশি মৃত্যু হয়েছে, সেটা করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে।

করোনার লকডাউনে বেশি চাপে ছিল শিক্ষার্থীরা। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে দীর্ঘ ১৮ মাস পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। ৫৪৩ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দীর্ঘ এই সময়ে ঘরবন্দী থাকে শিশুরা।  

যখন সর্বত্র করোনার ভয়, সেই সময়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাঁচাতে পিছপা হননি চিকিৎসকেরা 

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহীন স্কুল অ্যান্ড ক্যাডেট একাডেমিতে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে রেদওয়ান ইসলাম। লকডাউনের সময়ে কীভাবে দিন কেটেছে জানতে চাইলে রেদওয়ান বলল, ‘সারা দিন বাসায় থাকতাম, মাঠে যেতাম না। মোবাইলে ক্লাস করতাম, গেমও খেলতাম। মাঝেমধ্যে ছাদে খেলতে যেতাম। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো না।’    

করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের অনেকের দাফন–কাফনের লোকেরও অভাব পড়েছিল। সে সময় ভয়কে জয় করে এগিয়ে আসেন অনেক তরুণ–যুবা

আক্রান্ত রোগীকে নিয়ে একটি শয্যার আশায় হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘোরার চিত্রও দেখতে হয় করোনার সময়ে। আবার করোনায় দুঃসময়ে অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বাড়িয়ে দেয় সহমর্মিতার হাত। ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে এগিয়ে আসেন। কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রোগীদের বাড়ি পৌঁছে দেন, কেউ দরিদ্র ব্যক্তিদের খাদ্যসামগ্রী দেন সাধ্যমতো। করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফনেও এগিয়ে আসেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

শহর-গ্রাম সব মানুষের জীবনেই করোনা প্রভাব ফেলে। অনেকের মনেই ছিল ভয়, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, অতীতে কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়ার মহামারি আসত, দু-এক মাস থাকার পর বিদায় নিত। কিন্তু এভাবে ধনী-গরিব, প্রভাবশালী-সাধারণ, শহর-গ্রাম মিলে সব মানুষের জীবনে করোনার মতো প্রভাব ফেলার ঘটনা বিরল।

করোনার মধ্যে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর একপর্যায়ে শুরু হয় অনলাইন ক্লাস। মোবাইল–ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে ঘরে বসে ক্লাস করেন শিক্ষার্থীরা

করোনায় মৃত্যুর মিছিল দিনে দিনে দীর্ঘ হয়েছে। ২০২০ সালেই জাতির বহু গুণী ব্যক্তিকে হারাতে হয়েছে করোনায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, সাংবাদিক কামাল লোহানী, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, শিক্ষাবিদ নিলুফার মঞ্জুর, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এম এ হাসেম।

করোনার মধ্যে একপর্যায়ে সীমিত পরিসরে অফিস–আদালত ও কলকারখানা খুলে দিলে সব পথে দেখা দেয় ঢাকামুখী মানুষের চাপ  

লকডাউনের সেই সময়েই আসে রমজান মাস। ঘরে বসে সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করতে হয়। করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ঈদযাত্রায় ছিল কড়াকড়ি। পরস্পরের সঙ্গে মিলিত না হতে পেরে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হয়েছিল টেলিফোন বা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে। সেই ঈদের স্মৃতি মনে করে গৃহিণী কাউসার পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সময়ের মতো ঈদ আগে কোনো দিন কাটাইনি। ঈদ মানেই তো আত্মীয়স্বজন বাসায় আসবে। অথচ করোনায় ঈদ ছিল অনেকটা নিরানন্দ।’

তবে পরিবেশের জন্য অনেকটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল লকডাউন। সে সময় বাতাসে ধুলাবালি কম ছিল, শোনা যায়নি হর্নের শব্দ। সড়কে ছিল না চিরচেনা যানজট। প্রকৃতি ফিরেছিল আপন রূপে। সময়ের পরিক্রমায় করোনার সংক্রমণ এখন একেবারেই কম। টিকার আওতায় এসেছে দেশের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ। করোনার বিভীষিকাময় সময়ের কথাও যেন বিস্মৃত হতে শুরু করেছে মানুষ। অনেক দিন হলো মানুষের জীবনযাত্রাও আগের মতোই স্বাভাবিক হয়েছে।  

বাসে উঠলেও করোনা সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক পরতেন সবাই, চেষ্টা করতেন একজন আরেকজনের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার   ফাইল

বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ২০ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন মোট ২৯ হাজার ৪৯৩ জন। এখনো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। একজন দুজন করে মৃত্যুও হচ্ছে।

সেই ঈদের স্মৃতি মনে করে গৃহিণী কাউসার পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনার সময়ের মতো ঈদ আগে কোনো দিন কাটাইনি। ঈদ মানেই তো আত্মীয়স্বজন বাসায় আসবে। অথচ করোনায় ঈদ ছিল অনেকটা নিরানন্দ।’

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অতিরিক্ত মৃত্যু নিয়ে এক গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল অঙ্গরাজ্যের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভালুয়েশন জানিয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম দুই বছর বাংলাদেশে স্বাভাবিক বছরগুলোর তুলনায় ৩ লাখ ৩২ হাজার বেশি মৃত্যু হয়েছে, সেটা করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণে।

করোনার ভয়ে ঘরে বসে থাকলে পেট চলবে না। তাই কাজের খোঁজে বেরিয়েছেন দিনমজুর–খেটে খাওয়া ব্যক্তিরা। কিন্তু সে সময় কাজ পাওয়াও সহজ ছিল না

করোনায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের নানা ঘাটতি সামনে আসে। অপ্রতুল যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন সরবরাহ, জনবল, শয্যা ও আইসিইউ–সংকটে রোগীদের ভোগান্তি হয়। স্বাস্থ্য খাতের এসব ঘাটতির অনেক কিছু এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে যেসব কাজ করা প্রয়োজন ছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই হয়নি। করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে শিথিলতা চলে এসেছে। করোনা মহামারির মতো না হলেও ডেঙ্গুতে স্বাস্থ্য খাতের নানা অসংগতি আবারও সামনে এসেছে। দেশে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে ১ হাজার ৭০৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাব বলছে, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ৮৪৯ জনের। সেখানে শুধু ২০২৩ সালেই মারা গেছে আগের ২২ বছরের দ্বিগুণসংখ্যক মানুষ।