ফল

পাহাড়ি বেলের সৌরভ

খাগড়াছড়ি শহরের পানখাইয়াপাড়ার একটি গাছের ডালে ডালে ঝুলে আছে বেল l ছবি: লেখক
খাগড়াছড়ি শহরের পানখাইয়াপাড়ার একটি গাছের ডালে ডালে ঝুলে আছে বেল l ছবি: লেখক

সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় গাছের ডালে ডালে ঝুলে আছে বেল। এর সুগন্ধে মাতাল পাহাড়। পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে খাগড়াছড়িতেই সবচেয়ে বেশি বেল উৎপাদন হয়, এই হিসাব জেলার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের। এ বছরও ব্যাপক হারে হয়েছে এই ফল। জেলার নানা প্রান্তের বাজারে প্রতিদিনই উঠছে বেল।
এখন গরম পড়তে শুরু করেছে। এই গরমে তৃষ্ণা নিবারণে বেলের শরবতের জুড়ি নেই।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর ১৫৬ হেক্টর জমিতে বেল চাষ করা হয়েছে জেলায়। সদর উপজেলার চেলাছড়া এলাকার বেলচাষি হরিকুঞ্জ ত্রিপুরার ২৯টি বেলগাছ আছে। ২০০৭ সালে এসব বেলের চারা রোপণ করা হয়। হরিকুঞ্জ বলেন, ‘এবার কোনো গাছ থেকে ২০০ আবার কোনো গাছ থেকে সাড়ে ৫০০ বেল পাওয়া গেছে। এই মৌসুমে ফল বেচে ১ লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পাওয়া যেতে পারে।’
খাগড়াছড়ি সদরের ছোটগাছবান এলাকায় পাহাড়ের চূড়ায় রতন ত্রিপুরার ঘরের চারপাশে পাঁচটি বেলগাছ আছে। গাছে ফল কাঁচা থাকা অবস্থাতেই বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজার টাকায়। কিনেছেন খাগড়াছড়ির এক ব্যবসায়ী। রতন বলেন, ‘শুধু চারা কিনতেই যা খরচ। রোপণের পর থেকে আর কোনো খরচ নেই। তাই সামনে বড় আকারের বেলের বাগান করার চিন্তা করছি।’
খাগড়াছড়ির বাজারগুলোতে স্থানভেদে একটি কাঁচা বেল বিক্রি হয় সাত থেকে ১০ টাকায় আর পাকা বেল ১৫ থেকে ২৫ টাকা দরে। অন্যত্র একই বেল বিক্রি হয় থাকে প্রায় দ্বিগুণ দামে। তাই সস্তায় বেলের খোঁজে অন্য জেলার ফল ব্যবসায়ীদের আনাগোনা খাগড়াছড়িতে।
ঢাকা থেকে আসা বেল ব্যবসায়ী অহিত মিয়া বলেন, ‘২৫ বছর ধরে খাগড়াছড়িতে বেল ব্যবসা করছি। চাষিদের কাছ থেকে ১০০ বেল ১২০০ টাকায় কিনে নিই। ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া ও রংপুরে বেল নিয়ে বিক্রি করি। ১০০ বেলে ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।’
বেল শুধু সুস্বাদু ফলই না, এর ওষধি গুণও আছে। খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবদুর রউফ বলেন, ‘বেলে প্রচুর পরিমাণে শ্বেতসার, ক্যারোটিন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম ও লৌহ আছে। এর প্রতি ১০০ গ্রাম খাবারযোগ্য শাঁসে ৬২.৫% পানি, ১.৮ গ্রাম আমিষ, ৩১.৮ গ্রাম শ্বেতসার, ০.৩৯ গ্রাম স্নেহজাতীয় পদার্থ, ৮৭ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ৫৫ মিলিগ্রাম ক্যারোটিন, ০.১৩ মিলিগ্রাম থায়ামিন, ১.১ মিলিগ্রাম লৌহ আছে।’ বেলের উপকারিতা নিয়ে আবদুর রউফ জানান, পাকা ফল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং কাঁচা ফল কলেরা ও আমাশয়ে উপকারী। বেলের পাতা ও ছাল দিয়ে কবিরাজি ওষুধ তৈরি করা হয়।
দেশে বেলের কোনো অনুমোদিত জাত নেই। কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেন, যে অঞ্চলে জন্মায় সে অঞ্চলের নামানুসারেই জাতের নামকরণ করা হয়। বেলের শিকড় থেকে ফেঁকড়ি বের হয়, যা থেকে নতুন গাছও জন্মানো সম্ভব। জুন-জুলাই মাসে এক বা দুই বছরের চারা আদিজোড় হিসাবে ব্যবহার করে এর ওপর তালি কলম অথবা ফাটল কলমের মাধ্যমে সফলভাবে বংশবিস্তার করা যায়। বেলগাছ বাগান আকারে করতে চাইলে বর্গাকার পদ্ধতি অনুসরণ করা ভালো। বর্ষাকাল (জুন-জুলাই) বেলের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
খাগড়াছড়ি হর্টিকালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছর পাঁচেক হলো বাণ্যিজিকভাবে বেলের আবাদ শুরু হয়েছে খাগড়াছড়িতে। বেলের বাগানে বেশি যত্নের প্রয়োজন হয় না। তাই চাষিরা বেলের বাগান করতে আগ্রহী হচ্ছেন বেশি।’