গত ২৭ জুন প্রথম আলোর আয়োজনে ‘রক্ষা করি পরিবেশ, গড়ি সোনার বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো
‘৭০০ কোটি মানুষের অপার স্বপ্ন, একটি বিশ্ব, করি না নিঃস্ব’—স্লোগান সামনে রেখে এ বছরের পরিবেশ দিবস পালিত হয়। সম্পদের ভোগ ও উপভোগ যাতে পৃথিবীর প্রাণশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে এবং প্রকৃতিকে বিরূপ করে না তোলে, সে জন্য পৃথিবীবাসীকে সচেতন করতেই এবারের পরিবেশ দিবসের
মূল স্লোগান ঠিক করেছে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি)।
বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা বজায় থাকলে ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে ৯৬০ কোটি। তখন মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য তিনটি পৃথিবীর সমান সম্পদের দরকার হবে
বাংলাদেশে ২৫টি জৈব প্রতিবেশব্যবস্থা রয়েছে। এখানে ৩৯৫ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। জনসংখ্যার চাপ আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই প্রতিবেশব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলছে
সূত্র: ইউএনইপি এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়
আলোচনায় সুপারিশ
*প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে
* পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে
*জল ও বনভূমি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে
*নদী, বন ও জলাশয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে
*প্রতি জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস থাকতে হবে
*প্রতি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পরিবেশের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে থাকতে হবে
*যেকোনো প্রকল্প অনুমোদনের সময় পরিবেশের বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ জরুরি হয়ে উঠেছে। আমরা বুঝে বা না বুঝেই প্রতিনিয়ত প্রকৃতির ক্ষতি করছি। বন কেটে আবাস গড়ছি। জলাভূমি ভরাট, জ্বালানিশক্তির অপচয়, নদী ও বায়ু দূষণ করছি। এভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে নিজেদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলছি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের খুব সতর্ক হতে হবে।
প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় রোধে মনোযোগী হতে হবে। প্রকৃতির ক্ষতি না করলে সুন্দর ও বসবাসযোগ্য আগামীর বাংলাদেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে এখন আলোচনা করবেন ইমতিয়াজ ইবনে সাত্তার।
ইমতিয়াজ ইবনে সাত্তার: প্রতিবছর ৫ জুন জাতিসংঘ বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করে। আমরা তাই জুন মাসকে গুরুত্ব দিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে যৌথভাবে গোলটেবিলের আয়োজন করেছি। জাতিসংঘের এবার পরিবেশ দিবসের মূল স্লোগান ছিল, ‘৭০০ কোটি মানুষের অপার স্বপ্ন, একটি বিশ্ব, করি না নিঃস্ব’। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলেছি, ‘রক্ষা করি পরিবেশ, গিড় সোনার বাংলাদেশ’। কীভাবে পরিবেশ রক্ষা করে সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারি, আজকের আলোচনা থেকে সেটা বেরিয়ে আসবে। আমরা এমন এক সমেয় বাস করছি, যা সর্বদা পরিবর্তনশীল। ক্রমাগত পরিবর্তিত আবহাওয়া আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এর ফলে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বন্যা, ভূমিকম্প, সিডর, সাইক্লোনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হচ্ছে।
বেশি হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইকোসিস্টেম (প্রতিবেশব্যবস্থা) ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর কোনো ক্ষতি না করে মানবজাতির উন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা ছাড়াও আবহাওয়ার দিকটি গুরুত্বপূর্ণ।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। পরিবেশের ক্ষতি করে এমন কোনো প্রকল্পে আমরা ঋণ দিই না। আমাদের সব ঋণপ্রস্তাবের সঙ্গে পরিবেশ ও সামাজিক বিষয় প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমরা ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে যৌথভাবে জলবায়ু পরিবর্তন–বিষয়ক ক্যাম্পেইন করছি।
আমাদের ব্যাংকে সদ্য যোগদান করা সব সদস্যের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। ২০১২ সালে আমরা ‘সাসটেইনেবল ফিন্যান্স ট্রেনিং’ চালু করি। এর মাধ্যমে আমাদের রিলেশনশিপ ম্যানেজারদের গ্রিন ফিন্যান্স সম্পর্কে জানার ব্যাপক সুযোগ হয়েছে। গত বছর এই প্রশিক্ষণে ৬২০ জন কর্মী অংশ নেন।
কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে হাইব্রিড গাড়ি চালু করেছি। ঢাকার সব অফিসে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী লাইট স্থাপন করেছি। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে দুটি এটিএম মেশিনে সোলার পাওয়ার চালু করেছি।
এ ছাড়া বিদ্যুৎ বাঁচাতে ঢাকার সব অফিসে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয়করণ হয়েছে। ঢাকা অফিসে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়, এমন পানির কল লাগানো হয়েছে। আজকের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় আসবে। এর ফলে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার ও পরিচালনা করতে এবং সবুজ বাংলাদেশ গড়তে সুবিধা হবে।
আতিক রহমান: সমগ্র বিশ্ব পরিবেশের ধারণাকে একটি জায়গায় নিয়ে এসেছে—সেটা হলো টেকসই উন্নয়ন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের সে ধরেনর অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে হবে, যা পরিবেশসম্মত এবং সমাজের সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করে। সমাজের সুষম পরিবেশসম্মত উন্নয়নের কাজটি খুব কঠিন। কিন্তু এটি আমাদের করতে হবে।
ভবিষ্যতে সুন্দরভাবে বাঁচতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই। বাংলাদেশ পরিবেশের ক্ষেত্রে বেশ এগিয়েছে। আমাদের পরিবেশ–বিষয়ক আইন ও বিধিবিধান আছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের পরিবেশের বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। সব প্রকল্পের সঙ্গে পরিবেশের ক্ষতির বিষয় বিবেচনা করার কথা। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনে যখন প্রকল্পগুলো যায়, তখন লেখা হয়, এরকোনো ক্ষতিকর দিক অামাদের জানা নেই।
১৯৮৬ সাল পর্যন্ত দেশে কোনো পরিবেশ বিভাগ, মন্ত্রণালয় বা পরিবেশ–বিষয়ক অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল না। ১৯৮৬ সালের পর থেকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে প্রায় ৩০ বছরে অনেক কিছু করা হয়েছে। কিন্তু প্রথম আলোর সম্পাদকীয়তে দেখলাম, দিনাজপুরে লিচু খেয়ে কয়েকজন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। লিচুতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার এ মৃত্যুর কারণ।
এ ক্ষেত্রে সরকার, জনগণ সবার দায়িত্ব রয়েছে। একবার গবেষণার কাজে সাভার গিয়ে দেখি, বেগুনে অতিরিক্ত কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে কৃষকেরা বললেন, ‘আমরা এটা খাই না, ঢাকায় পাঠাই।’ এখানে সরকারসহ জনগণেরও বড় দায়িত্ব আছে। পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সবাই যদি দায়িত্ব পালন করি, তাহলে সেটা হবে পরিবেশের সুশাসন। এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেেন্টর আইনের মাধ্যমে সরকার পরিবেশ রক্ষা করতে পারে। অর্থাৎ কোনো প্রকল্প গ্রহণ করলে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে, এ মূল্যায়নের মাধ্যমে সেটা জানা যায়। এ জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি সুপারভাইজরি বোর্ড করতে হবে। এ বোর্ড কোনো প্রকল্প গ্রহণ করলে পরিবেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে এবং কীভাবে ক্ষতিকর প্রভাব সংশোধন করা যায়, সেসব বিষয়ে পরামর্শ দেবে।
পরিবেশের সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। এই দিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আজ একটু বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ আমাদের জমি দখল প্রায় শেষ হয়েছে; এখন নদী দখল চলছে। জমি ও নদী দখলের ফলেই ঢাকা শহরের এই জলাবদ্ধতা।
ঢাকার পাশের নদীগুলোর পানি আজ সব প্রাণীর জন্যই অযোগ্য। যারা শিল্পায়ন করছে, সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জনগণ—সবাইকে এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে। পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। কারণ, তাদের দায়িত্ব হবে সবচেয়ে বেশি।
সামিনা মজুমদার তুলি: প্রতিনিয়ত নগরায়ণের ফলে প্রকৃতি ধ্বংস করছি। গাছপালা কাটছি। জলাশয় ভরাট করছি। এর ফলে শহরের একটা নিজস্ব পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ২০১২ সালে করা আমার এক গবেষণায় দেখা যায়, আবহাওয়া অফিস বলছে, তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু ওই দিনই শহীদ মিনার এলাকার তাপমাত্রা ছিল ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা হলো শহীদ মিনার এলাকার নিজস্ব তাপমাত্রা।
ভবন নির্মাণবিধিতে ভবনের চারপাশে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ছাড়ার নিয়ম অাছে। কিন্তু অনেকে এ নিয়ম মানছে না। আবার যারা জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করছে, তারা ফাঁকা জায়াগা পাকা করে ফেলছে। ফলে একটি ভবনের চারপাশের জায়গা পাকা হয়ে যাচ্ছে। এসব পাকা জায়গার ওপর সূর্যরশ্মি পড়ে বিকরিত হয়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে।
একে বলে মিন রেডিয়েন্ট টেম্পারেচার। মিন রেডিয়েন্ট টেম্পারেচারের ফলে ওই এলাকার স্বাভাবিক অবস্থা ব্যাহত হয়। এ কারণে এসব এলাকার ভবনে বিদু্যতের ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। ফলে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়। এই বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে পরিবেশে আরও বেশি কার্বন নির্গমন হয়। আমাদের আরও একটি গবেষণায় দেখা যায়, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে ১০ থেকে ১২ শতাংশ মিন রেডিয়েন্ট টেম্পারেচার বেড়ে যায়। এ জন্য ২০ থকে ২৫ শতাংশ বিদু্যতের ব্যবহার বেড়ে যায়। তাই বাড়ির চারপাশের খোলা জায়গা পাকা না করে গাছপালা ও ঘাস লাগানো বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।
ইসতিয়াক সোবহান: বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হচ্ছে আমাদের ৭০০ কোটি মানুষ এবং মানুষের ভোগ।
পৃথিবীতে এমন কোনো সমস্যা নেই, যার সঙ্গে এই ক্রমবর্ধমান মানুষের সম্পৃক্ততা নেই। গত ৫০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা ৩২০ কোটি থেকে ৭২০ কোটি হয়েছে। এ বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের ভোগের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। ২০০৭ সালের হিসাবে একজন আমেরিকানের দরকার ৮ হেক্টর ভূমি আর একজন বাংলাদেশির দরকার মাত্র শূন্য দশমিক ৬২ হেক্টর।
২০০৮ সালের হিসাবে সমগ্র পৃথিবীতে জল ও স্থল মিলিয়ে মোট উৎপাদনশীল ভূমির পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন হেক্টর। আর এ সময়ে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ছিল ৬৭০ কোটি, যার অর্থ হচ্ছে সে সময়ে আমাদের মাথাপিছু উৎপাদনশীল ভূমির পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৮ হেক্টর করে, এই পরিমাপকে গ্লোবাল হেক্টর বলা হয়।
বর্তমানে আমরা যে সম্পদ ব্যবহার করি, তা উৎপাদন করতে দেড়টা পৃথিবীর দরকার হবে। এ ক্ষেত্রে দেশে দেশে অনেক পার্থক্য রয়েছে। আমরা যদি সবাই আমেরিকান বা দুবাইয়ের মতো হতে চাই, তাহলে এখনই আমাদের পাঁচটা পৃথিবীর সম্পদ লাগবে। আবার পৃথিবীর সবাই যদি আমাদের মতো করে চলে, তবে পৃথিবীতে দুই হাজার কোটি মানুষ থাকতে পারবে। কিন্তু আমাদের সবার চাহিদা আমেরিকান হওয়ার। যে জন্য প্রতিবেশব্যবস্থাগুলো, যা আমাদের পানি, খাদ্য, জ্বালানিসহ বসবাস করার মতো পরিবেশ দেয়, সেগুলো তাদের টেকসই উৎপাদনসীমা পার করেছে।
এর ফলে বেশির ভাগ প্রতিবেশব্যবস্থা ধ্বংস হবে বা হচ্ছে। এই মুহূর্তে টের পাচ্ছি না। ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে এক হাজার কোটি বা তারও বেশি।
আমরা কি এভাবে চলতে থাকব? এটা হতে পারে না। প্রকৃতি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেভাবেই মানুষের কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হতে হবে। আমাদের প্রতিবেশব্যবস্থাগুলো ধ্বংস করলে আমরা নিজেরাই ধ্বংস হব।
এ টি এম নুরুল আমীন: আমরা সুন্দর বাংলাদেেশর স্বপ্ন দেখি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও সাধারণ মানুষের কী করণীয়, সেটি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
১৯৮৭ সালের সবার ভবিষ্যৎ ও টেকসই উন্নয়নের ধারণায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশের তিনটি বিষয় ছিল। পরিবেশে নিয়ে বিশ্ব অনেক সচেতন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যয়ের মুখে।
বাইরে বের হলেই ডাস্টবিন থেকে বিভিন্ন বস্তুর দুর্গন্ধে নাক–মুখ বন্ধ রাখতে হয়। সারাক্ষণ শরীরে ধুলাবালু উড়ে আসতে থাকে। আজ বুড়িগঙ্গার পানি সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী। এসব দূষণ আমরাই তো করছি। আমরা নিজেরা যদি সচেতন না হই, তাহলে পরিবেশ কখনোই রক্ষা করতে পারব না। কেবল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে হবে না; সিদ্ধান্ত হতে হবে নির্দিষ্ট। সিদ্ধান্তগুলো স্থানীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের উদে্যাগ নিতে হবে। আমরা বায়ু দূষণমুক্ত করতে চাই। আবার অার্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সমানে গাড়ির জন্য ঋণ দেয়, তাহলে কীভাবে পরিবেশ ভালো থাকবে? এসব বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ১৯৯৪ সালে জাপানে দেেখছি, সে দেশের হাজার হাজার মানুষ হেঁটে চলছে। এরপর যতবার গিয়েছি, দেখেছি গাড়ি চলার রাস্তা কমছে হাঁটার রাস্তা বাড়ছে। কলকাতা প্রায় ২৫ বছর আগে গণপরিবহন করেছে। আর আমরা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে আজও গণপরিবহন করতে পারলাম না। কিছু দেশ পরিবেশ ধ্বংস করে মুনাফা করছে আবার পরিবেশ রক্ষার নামে প্রযুক্তি বিক্রি করে মুনাফা করছে। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাকরিমুখী। বিষয় হিসেবে পরিবেশ কম গুরুত্ব পায়। এসব কারণে পরিবেশ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
আলমগীর হোসেন: আমাদের সবার বড় স্বপ্ন দেখায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিয়ে সমস্যা আছে। এ বছরটি আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ বছর সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ৵মাত্রার সময় (এমডিজি) শেষ হবে। সামনে এসডিজি (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল)।
এমডিজিতে এনার্জি (শক্তি) নিয়ে তেমন ভাবা হয়নি। কিন্তু এসডিজিতে এনার্জি ভীষণভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে। বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলো উন্নয়নশীল। ২০২১ ও ২০৪১ সালে আমরা যথাক্রমে মধ্যম ও উন্নত বাংলাদেশ হতে চাই। তাহলে বিপুল পরিমাণ এনার্জি রিজার্ভ থাকতে হবে।
২০৩০ সালে আমাদের লক্ষ্য ৩৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। গৃহে ব্যবহার করা হয় এমন ছয়টি ইলেকট্রনিকস দ্রব্যের ব্যবহারের ওপর গবেষণা করে দেখেছি, যদি কিছুটা সতর্ক হয়ে এসব দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, তাহলে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চয় করা সম্ভব।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কথা আসছে। কিন্তু আমাদের ৬৪টি জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস নেই। প্রতি জেলায় পরিবেশ অধিদপ্তরের অফিস থাকতে হবে। তাদের জনবল খুব কম। এত কম জনবল দিয়ে যেকোনো একটা জাতীয় নীতি বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। সরকারকে এ বিষয়গুলো ভাবতে হবে। বাংলাদেশ বৈশ্বিক পরিবেশ ফোরামে খুব সক্রিয় অংশগ্রহণকারী দেশ। অনেক সময় আমাদের দায়িত্ব না জেনেই আন্তর্জাতিক সনদে সই করি। পরিবেশকে কেবল পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বিষয় ভাবলে চলবে না; পরিবেশ সবার বিষয়। কারণ এটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হব।
ব্যক্তি খাতের সঙ্গে সরকার ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্য সংশ্লিষ্ট সবাই যদি পরিবেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব এখন থেকে না দিই, তাহলে ভবিষ্যতে সবাই হয়তো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ব।
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ: পরিবেশ নিয়ে বহুমুখী আলোচনা হচ্ছে। আনেকে ভাবেন, বন, বন্য প্রাণী, জলাভূমি এগুলো থাকলেই কী বা না থাকলেই কী।
আমাদের ভালো নীতি, আইন আছে, কিন্তু কেন যেন এগুলোর প্রয়োগ দেখি না। কোথায় যেন ঘাটতি রয়েছে। পরিবেশের উপাদানগুলো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বনে কেবল বৃক্ষ নয়, বৃক্ষের সঙ্গে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ থেকে শুরু করে বৃহৎ বন্য প্রাণীসহ সবকিছুর একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। উদ্ভিদের সঙ্গে উদ্ভিদ ও প্রাণী, আবার প্রাণীর সঙ্গে প্রাণী ও উদ্ভিদের সম্পর্ক রয়েছে। এদের কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সমগ্র পরিবেশে তার প্রভাব পড়বে।
যে বনে বৃক্ষ নেই, সে বনের প্রতিবেশব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। আজ জলাভূমির দিকে তাকাই, জলাভূমিগুলো দিন দিন বিপন্ন হচ্ছে। জলভূমিতে কেবল মাছ নয়, মাছ ছাড়াও অনেক উপাদন আছে, যেগুলো পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জলাভূমির জীববৈচিত্র৵ যদি বিনষ্ট হয়, তাহলে পরিবেশের কী ক্ষতি হবে, আমরা তা কল্পনাও করতে পারব না। কিন্তু এখন জলাভূমির ব্যবস্থাপনায় শুধু মুনাফা অর্জনের দিকটি বিবেচনা করা হয়। নদী দিয়ে কেবল পানি প্রবাহিত হয় না, নদীর মধ্যে একটি জীববৈচিত্র৵ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে নদীর সব সম্পদ মানবকল্যাণে আসছে। কিন্তু আজ সেই নদীর কী অবস্থা, সেটা সবাই জানি।
আজ ঢাকার সবুজ একটু একটু করে হািরয়ে যাচ্ছে। নগর পরিকল্পনার সময়ও সবুজ ধরে রাখার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। তাই এখন শহর ও নগরের পরিবেশ ধ্বংস হয়েছে। শহরের অভ্যন্তরে, চারপাশে যেসব নদী ছিল, সেগুলো ধ্বংস হয়েছে। নদীগুলো ক্রমাগত দখল হচ্ছে। শিল্পবর্জ্যে দূষিত হচ্ছে। নদী ও জলাভূমি থেকে আমাদের যেসব সম্পদ পাওয়ার কথা, সেগুলো পাচ্ছি না।
পরিবেশ রক্ষায় যে বিধিবিধান প্রয়োগের কথা, আমরা সেটা প্রয়োগ করতে পারছি না অথবা প্রয়োগে আন্তরিক নই। আমাদের রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক সবাই খুব ভালো কথা বলেন। কিন্তু কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এর প্রতিফলন ততটা দেখা যায় না। নীতিনির্ধারক, প্রশাসক, বাস্তবায়নকারী সংস্থা এদের সবার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সরকারের কোনো একটি সংস্থা একিট বিষয়কে যখন গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, তখন অারেকটি সংস্থা তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। এই সমন্বহীনতার জন্য তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। জল ও বনভূমি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় জনগণের সম্পৃক্ততা রাখতে হবে। আমাদের জল ও বনভূমির চারপাশে অসংখ্য মানুষ রয়েছে। তাদের উপেক্ষা করে কোনো সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা টেকসই হবে না।
খন্দকার সাব্বির আহমেদ: ১০ থেকে ১৫ বছর যাবৎ পরিবেশ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। মানুষ পরিবেশের গুরুত্ব কিছুটা বুঝতে পারছে। গণমাধ্যমও পরিবেশ নিয়ে অনেক ভালো প্রতিবেদন করছে। যতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়, সমস্যা সমাধানের জন্য তেমন গুরুত্ব দেখতে পাই না। এটাই হলো প্রধান সমস্যা। কেন সমাধান হচ্ছে না? ধরেই নিচ্ছি যে আমরা পারব না। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে। অনেক উন্নয়ন সূচকে আমরা এগোচ্ছি। আমরা এখন জনসংখ্যা সুবিধা তত্ত্বের মধ্যে আছি। এই সুবিধা ১৫ থেকে ২০ বছর হয়তো থাকবে। আমাদের প্রতিবেশব্যবস্থা ঠিক না থাকলে এসব সুবিধাকে কাজে লাগাতে পারব না। উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের শুরুর দিকে এমন অবস্থা ছিল। তারা সমস্যাগুলো উত্তরণ করে আজ সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছে। যেকোনো অসংগতির বিপরীতে একটা সুন্দর সম্ভাবনা থাকে। আমাদের সে লক্ষে৵ কাজ করতে হবে।
আমাদের দেশ বিভিন্নভাবে উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে। নদীদূষণ ও যানজটের পেছনে একটা উন্নয়নের চিত্র আছে। আমরা উন্নয়ন থামিয়ে দিতে চাই না। কিন্তু কীভাবে এসবের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা যাবে, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
উন্নত দেশগুলোতেও এমনই হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ যখন কেবল সেলাই করত, তখন কিন্তু এত পরিবেশদূষণ ছিল না। বাংলাদেশ যখন ডায়িংসহ সব কাজ করা শুরু করেছে, তখন কিন্তু আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেেশ পরিণত হয়েছি।
আমাদের নদীসহ সব ধরনের দূষণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দূষণের জন্য এই শিল্প বন্ধ করে দিতে পারি না। আমাদের যেটা করতে হবে, সেটা হলো দূষণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা। এসবের জন্য আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ খুঁজে বের করতে হবে।
মুহাম্মদ জাকির হোসেন খান: এখন আলোচনার চেয়ে বেশি প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বিত কোনো পদক্ষেপ আমরা নিতে দেখি না। এটি একটি বড় সমস্যা। ২০১৫ সালে প্যারিসে জলবায়ু বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হবে। এর নেতৃত্ব বাংলাদেশ দিতে পারত। কেন পারল না, আমরা জানি না। প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সংগতি রেখে আমাদের কিছু করণীয় ঠিক করতে হবে, সে উদ্যোগ কিন্তু দেখছি না।
যেকোনো জাতীয় দুর্যোগ হলে সেটা মোকাবিলার জন্য আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ নেই। এসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন নারী ও শিশুরা। অথচ এ পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য যে তহবিল দেওয়া হয়েছে, তার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ নারী ও শিশুদের জন্য দেওয়া হয়েছে।
এত কম তহবিল দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি, তহবিল ব্যবহারের সক্ষমতা নেই। কিন্তু তহবিলের প্রয়োজন আছে। কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সমাধানের চিন্তা করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সরকারের নেই। আমরা এক জিরপে দেখেছি, কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের সঙ্গে তৃণমূল মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ফলে পরিকল্পনাগুলো টেকসই হচ্ছে না। বলা হয়, উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশ দেখা যাবে না। যে করণে সুন্দরবন এলাকায় কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদানের অনুমোদন দেওয়া হয়।
সর্বশেষ এক সংবাদে দেখলাম, ফ্রান্সের অার্থিক প্রতিষ্ঠান রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন করতে অস্বীকার করেছে। এর আগে নরওয়ের পেনশন তহবিল অর্থায়ন বন্ধ করেছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ প্রকল্পকে যথাযথ মনে করছে না। বিশ্বে এখন প্রযুক্তিতে প্রধান যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নর্থ ক্যারোলাইনা রাজ্যের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কোম্পানির বিরুদ্ধে ভয়াবহ পরিবেশদূষণের জন্য মামলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরে ৩৭টি রাজ্যে ২০৭টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তারা ১৮৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করেছে। প্রস্তাবিত ১৮৩টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছে। আমরা কি প্রযুক্তিতে এতই উন্নত হয়েছি যে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না? এসব বিষয় আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
মো. ইউনুছ আলী: আজকের আলোচনায় শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের পরিবেশ নিয়ে কথা হয়েছে। পৃথিবী এখন উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিভক্ত। প্রত্যেকের সমস্যা তাদের নিজেেদর মতো করে। ১১৫টি দেশের বাসযোগ্যতার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩।
২০১৪ সালে এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স করা হয়। এ সূচকে ১৭১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৯। আমাদের মূল্যায়ন হলো কৃষি প্রতিবেশব্যবস্থা, জলাশয় ও পানিসম্পদের অপরিণামদর্শী ব্যবহার। দুর্বল পরিকল্পনার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ঢাকার চারপাশের নদীগুলো এক অর্থে আর নদী নেই। সব কটি নদীর পানিই দূষিত। এ ছাড়া রয়েছে লবণাক্ততা, পলি পড়া ইত্যাদি সমস্যা। দেশের অভ্যন্তরের অনেক নদী দখল হয়েছে এবং এর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। নদী, বন ও জলাশয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য আলাদা একটি খতিয়ান প্রয়োজন।
১৯৫০ সালের ভূমি ব্যবস্থাপনা আইন এখনো চলছে। ভূমির শ্রেণিবিন্যাস কে করবেন? জেলা প্রশাসক। কোন ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করবেন? ইকোসিস্টেম নীতির ওপর ভিত্তি করেই িতনি এ কাজ করবেন।
এখন খাদ্যে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক মেশানো হয়। এগুলো দেখার যেন কেউ নেই। উপকূলীয় এলাকার জলোচ্ছ্বাসের সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকা মহানগরে জলাবদ্ধতা হলে কে দেখবে? সিটি করপোরেশনকে দেখতে হবে।
পরিবেশ রক্ষায় ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে স্থানীয় সরকার, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ। এখানে কার কী দায়িত্ব, সেটা নির্দিষ্ট করতে হবে। সবাই সমন্বিতভাবে কাজ না করলে পরিবেশকে রক্ষা করতে পারব না। ১৯৯৪ সালে বন নীতিমালা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে হয়েছে পরিবেশ আইন। ১৯৯৭ সালে বন আইন হয়েছে।
আইন, নীিতমালা থাকলেও পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা তেমন এগোতে পারছি না। মনে করি, অনেক বেশি আইনের প্রয়োজন নেই। কেবল পরিবেশ আইন থাকবে। সংশ্লিষ্ট সবাই পরিবেশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করবে। ভৌত ও যৌগ পরিবেশের যেকোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের বন, কৃষি, জলাশয়সহ পাঁচটি ইকোসিস্টেম রয়েছে। এগুলো রক্ষার পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। ঢাকা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান িনয়ে কিছু বলতে চাই না। আমরা ঢাকা শহরে একাধিক ফ্ল৵াটের মালিক। তারপরও ঢাকার আশপাশে আরও ফ্ল৵াটের মালিক হতে চাই। ভূমি ইজারা দেওয়ার নীতির সঙ্গে বন ও জলাশয় সংরক্ষণের বৈপরীত্য আছে। এটা দূর করা প্রয়োজন।
আইনুন নিশাত: চারপাশে যা আছে, তা-ই আমাদের পরিবেশ—এই বোধ ধারণ করতে পারলে প্রতিদিন ঝাড়ুদারদের একগাদা কাগজ আর পলিথিন সংগ্রহ করতে হতো না। আমাদের ব্যক্তিগত অভ্যাস পরিবর্তন প্রয়োজন।
বৈশ্বিক কারণে পরিবেশের পরিবর্তন আসছে। মাত্র সাত দিন আগে এমআইটি, হার্ভার্ড ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পৃথিবী যেভাবে চলছে, তাতে কিছুদিন পর মানুষও থাকবে না। কারণ, জীববৈচিত্র৵ সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে।
হল্যান্ডে জজ সাহেবরা রায় দিয়েছেন, ২৫ শতাংশ নয়, ৪০ শতাংশ কার্বন হ্রাস করতে হবে। ২০০ বছর পর পোপ পরিবেশের ব্যাপারে আদেশ জারি করেছেন। আমরা কার্বন উৎপাদন করি না, কিন্তু এর ক্ষতির শিকার হচ্ছি। আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। আমরা যত খুশি কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি, কিন্তু সেটা রামপালে কেন?
অনেক সমস্যা আছে আন্তর্জাতিকভাবে ছাড়া সমাধান করা সম্ভব না। পানির জন্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সঠিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে না। পানি, নৌ, বিদ্যুৎ ইত্যাদি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ ক্ষেত্রে জটিলতা আছে। কে কাজ করবে, কার দায়িত্ব বেশি–কম—এসব নিয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বড় ধরনের সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
আঞ্চলিক একটি সমস্যা হলো তেল। রেললাইনের সেতু ভেঙে পড়ে যাওয়া দুিট ট্যাংকারের তেল আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। সাধারণ বুম দিয়ে ঠেকানো যেত শ্যালা নদীর তেল। কলাগাছ দিয়েও বুম বানানো যায়। এটা করতে সরকারের সাত দিন লেগেছে। বঙ্গোপসাগরে একটা ট্যাংকার ডুবলে কী হবে আমরা জানি না। আমাদের জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। বন কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে? বন যারা দখল করে, তারা এত শক্তিশালী যে ইউনুছ সাহেবসহ আমরা তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েও কিছু করতে পারব না।
সুখের সংবাদ হলো, সুন্দরবনকে তাঁরা কিছুটা রক্ষা করতে পেরেছেন। কিন্তু ঢাকার পাশের বনে শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। বিদেশিরা পর্যন্ত আমাদের কোস্টাল জোন পলিসির প্রশংসা করেছে। কিন্তু এর কোনো প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নেই। প্রতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের মধ্যে পরিবেশের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে থাকতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে কেবল বন মন্ত্রণালয় না, সংশ্লিষ্ট সবাইকে কাজ করতে হবে। আমাদের জলাশয়গুলো রক্ষার উদ্যোগ খুব জরুরি।
নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করতে হবে। প্রতিটি প্রকল্প অনুমোদনের সময় পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। যেকোনো প্রকল্প অনুমোদনের সময় পরিবেশের বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
এই গোলটেবিল আলোচনায় আমন্ত্রিত অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য সম্পূর্ণ তাঁদের নিজস্ব মতামত। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের যেকোনো মতামতের ব্যাপারে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক কোনো দায়দায়িত্ব বহন করে না।
যাঁরা অংশ নিলেন
আইনুন নিশাত : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
মো. ইউনুছ আলী : প্রধান বন সংরক্ষক
ইমতিয়াজ ইবনে সাত্তার : চিফ ফাইন্যান্স অফিসার, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক
আতিক রহমান : নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজ
এ টি এম নুরুল আমীন : অধ্যাপক, পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ : কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইইউসিএন
খন্দকার সাব্বির আহমেদ : অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বুয়েট
আলমগীর হোসেন : পরিবেশ বিভাগের প্রধান, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)
সামিনা মজুমদার তুলি : শিক্ষক, স্থাপত্য বিভাগ, বুয়েট
মুহাম্মদ জাকির হোসেন খান : সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ক্লাইমেট ফাইন্যান্স গভরর্ন্যান্স, টিআইবি
ইসতিয়াক সোবহান : পরিবেশ–বিষয়ক পরামর্শক, বিশ্বব্যাংক
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো