
শকুন মড়াখেকো মাংসাশী পাখি। তাই তাকে কেউ ভালো চোখে দেখে না। লোভী আর নির্দয় কাউকে কটাক্ষ করতে গিয়ে অনেকে শকুনের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। শকুনের প্রতি নাক সিঁটকানো এই মনোভাবের কারণে পাখিটির বংশ নিপাত হওয়ার জোগাড়। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে, উপলব্ধি হয়েছে শকুন মানুষের শত্রু নয়, বরং বন্ধু।
গবেষণায় শকুন সম্পর্কে বেরিয়ে আসছে অজানা তথ্য। বলা হচ্ছে যে শকুন পচা-গলা মাংস খাওয়াসহ ভয়াবহ অনেক জীবাণু হজম করে থাকে। এ জন্য আজ একটু শুভকামনা। শকুন রক্ষায় আজ শনিবার বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস’।
ইংরেজিতে ‘ভালচার’ বলে পরিচিত শকুনের গলা, ঘাড় ও মাথায় কোনো পালক থাকে না। প্রশস্ত ডানায় ভর করে আকাশে ওড়ে। লোকচক্ষুর আড়ালে বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, ডুমুর ইত্যাদি বড় গাছে সাধারণত শকুন বাসা বাঁধে। গাছের কোটর, পর্বতের চূড়ায় ও গুহায় সাদা বা ফ্যাকাশে রঙের এক থেকে তিনটা ডিম দিয়ে থাকে। রং সাদা বা ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। এরা মাংসাশী, বিশেষ করে মৃত প্রাণীর মাংস খেয়ে থাকে এই শিকারি পাখি।
বিশ্বে ২৩ প্রজাতির শকুন রয়েছে। এর মধ্যে চার ধরনের শকুন বাংলাদেশে আসে। এরা স্থায়ীভাবে থাকে না। পরিযায়ী। এগুলো হচ্ছে হিমালয় গৃধিনী, ইউরেশীয়, ধলা ও কালা শকুন। হিমালয় গৃধিনী ও ইউরেশীয় শকুন প্রায়ই আসে, আবার চলে যায়। তবে পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধলা শকুনকে ৪০ বছর পর গত জুনে কাপ্তাইয়ে দেখা গেছে। কালা শকুন মাঝেমধ্যে দেখা যায়।
তিন ধরনের শকুন এ দেশে বাসা বানিয়ে ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটাত। এগুলো হচ্ছে রাজ শকুন, সরু ঠোঁট শকুন ও বাংলা শকুন। রাজ শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ৩৫ বছর পর সরু ঠোঁট শকুন এবার হবিগঞ্জের একটি বনে দেখা গেছে। তার বাসাও পাওয়া গেছে। মোটামুটি থাকার মধ্যে রয়েছে বাংলা শকুন।
এক হিসাবে জানা গেছে, বাংলাদেশে এর সংখ্যা তিন শর বেশি হবে না। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তান মিলে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। আশির দশকে সার্কভুক্ত দেশে প্রায় ৪০ মিলিয়ন বাংলা শকুনের অস্তিত্ব ছিল। গত তিন দশকে উপমহাদেশে ৭৫ শতাংশ শকুন মারা গেছে।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে ওক তাঁর এক গবেষণায় প্রমাণ করেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনের ব্যবহারই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। ভারতে প্রতিবছর ৩০ শতাংশ শকুন মারা যাওয়ার কারণও ডাইক্লোফেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত মরা পশুর মাংস খেয়ে কাক-শিয়াল কোনো প্রাণীই বাঁচতে পারে না। তারাও আক্রান্ত হয়। এমনকি অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরু মাটিতে পুঁতে ফেললেও তার জীবাণু বহুদিন পর্যন্ত ধ্বংস হয় না। একমাত্র শকুনই অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু হজম করে ফেলতে পারে। এখন চারদিকে যেভাবে অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে, এতে আক্রান্ত পশু মানুষের সংস্পর্শে এলে মানুষও আক্রান্ত হবে। আক্রান্ত মরা পশু সরিয়ে ফেলতে শকুনের কোনো বিকল্প নেই।
অনেক দেরিতে হলেও জানা গেছে শকুন অশুভ কোনো পাখি নয়, তারা মানুষের বন্ধু। মানুষের ভেতর এই সচেতনতা সৃষ্টিতে এবং শকুন সংরক্ষণে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) কাজ করছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে আইইউসিএনের উদ্যোগে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি হয়েছে। এই কমিটির উদ্যোগে বাংলা শকুন সংরক্ষণে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলেই বাংলাদেশ সরকার বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে বাংলা শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। ভারতে এ রকম পাঁচটি ও নেপালে দুটি এলাকাকে বাংলা শকুনের জন্য নিরাপদ অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে।
অবশ্য তার আগেই ভারতে ২০০৬ সালে এবং বাংলাদেশে ২০১০ সালের নভেম্বরে ডাইক্লোফেনাক ওষুধ নিষিদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে। অনেক দেশ বিকল্প ওষুধ ব্যবহার করছে।
এবার আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস উপলক্ষে বন বিভাগ এবং আইইউসিএনের উদ্যোগে দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। গত ২৭ আগস্ট শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম অনুষ্ঠানটি হয়ে গেছে। আজ দ্বিতীয়টি হচ্ছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে। কাল রোববার দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি হবে চুনারুঘাটের একটি বিদ্যালয়ে। ১০ সেপ্টেম্বর হবে খুলনা অফিসার্স ক্লাবে।
এই দিবস উপলক্ষে বন বিভাগ বাংলা শকুন রক্ষা প্রকল্পের সহায়তায় একটি পোস্টার করেছে। এতে লেখা হয়েছে ‘নির্মল প্রকৃতি ও সুস্থ প্রকৃতির জন্য মহাবিপন্ন বাংলা শকুন রক্ষা করি’।