বিপন্ন প্রাণী

হনুমান

কুষ্টিয়ায় রেললাইনের পাশে হনুমান l ছবি: লেখক
কুষ্টিয়ায় রেললাইনের পাশে হনুমান l ছবি: লেখক

১৭ এপ্রিল ২০১৫, সকালে কুষ্টিয়ায় লালন ফকিরের আখড়ায় যাচ্ছি। আখড়ার খানিকটা আগে রেলক্রসিংয়ের কাছে হঠাৎই ওকে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে অটোচালককে থামতে বললাম। রেললাইনের পাশে চমৎকার ভঙ্গিতে বসে ছিল। এভাবে এই মহাবিপন্ন প্রাণীটির দেখা পাব, তা ভাবিনি। শান্তভাবে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে যেন ও আমাকেই দেখছিল।
২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারিতে বিপন্ন এই প্রাণীগুলোকে দেখতে যশোরের কেশবপুরে গিয়েছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যায় বাজারের সামনে একটি দলের দেখা পেলাম। দুই ডজন কলা কিনে ডাকতেই ওরা আমার কাছে চলে এল। জীবনে তো কম প্রাণীর মুখোমুখি হইনি। কিন্তু ওদের মতো ভদ্র প্রাণীর দেখা পাইনি কোথাও। ওরা ভদ্রভাবে একে একে এসে কলা নিয়ে গেল। কেউ হুড়োহুড়ি বা মারামারি করল না। নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না।
হিন্দু পুরাণ রামায়ণে হনুমানের উল্লেখ আছে। এরা হানু বান্দর (Hanuman Langur, Common Langur, Grey Langur বা Entellus Monkey) নামেও পরিচিত। Cercopithecidae গোত্রের এই প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম semnopithecus entellus । বর্তমানে একমাত্র খুলনা বিভাগের যশোর ও কুষ্টিয়ার কিছু গ্রামে, বিশেষত যশোরের কেশবপুরে বেঁচেবর্তে আছে।
হনুমানের দেহ সরু ও হাত-পা লম্বা। দেহের তুলনায় লেজ বেশ লম্বা। মাথা থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৫০ সেন্টিমিটার ও লেজ ৭০ সেন্টিমিটার লম্বা। ওজন ৮-২০ কেজি। আকার ও ওজনে পুরুষগুলো বেশ বড়। এদের চামড়ার রং কালচে। দেহের ওপরটা ধূসর ও নিচটা সাদাটে-ধূসর থেকে হালকা বাদামি। মুখমণ্ডল, কান, হাত ও পায়ের পাতা কালো বা বাদামি। মাথার মাঝখানে হালকা রঙের চূড়া। চোখের ওপর কালো ভ্রু। অপ্রাপ্ত বয়স্কগুলোর রং বাবা-মায়ের থেকে হালকা।
দেশের তিন প্রজাতির হনুমানের মধ্যে একমাত্র এরাই দিনের বেশির ভাগ সময় মাটিতে কাটায়। রাত ছাড়া তেমন একটা গাছে গাছে চড়ে না। একাধিক পুরুষের নেতৃত্বে একেকটি দলে ১৫-২৫টি হনুমান বাস করে। যদিও নিজেদের সীমানায় অন্য দলকে ঢুকতে দেয় না, কিন্তু এরা বেশ শান্তিপ্রিয়। নিজেদের মধ্যে মারামারি করে না।
শুষ্ক বনভূমি থেকে খোলামেলা জঙ্গল ও ঝোপঝাড়, গ্রাম ও শহরসহ মিশ্র তৃণভূমিতে বাস করে। গাছের কচি পাতা, কুঁড়ি, ফুল, ফল, মূল, শস্যদানা ইত্যাদি খেয়ে জীবন ধারণ করে। তবে আমাদের নাগরিক জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে বলে মানুষের দেওয়া বিভিন্ন খাবার অনায়াসেই খায়। সাধারণত সকাল ও বিকেলে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। দুপুরে বিশ্রাম নেয়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলেই নিজেদের নির্দিষ্ট গাছে চলে যায় ও রাত যাপন করে। দিনের অনেকটা সময় একে অন্যের দেহ চুলকিয়ে সময় কাটায়।
জানুয়ারি-মে প্রজননকাল। স্ত্রী ১৮০-২০০ দিন গর্ভধারণের পর একটি বা কদাচ দুটি বাচ্চা প্রসব করে ও প্রতি দুই বছরে একবার বাচ্চা দেয়। বাচ্চারা ১৩ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে। পুরুষ ৫-৬ ও স্ত্রী ৩-৪ বছরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। আয়ুষ্কাল ১৮-৩০ বছর। বর্তমানে এদের সংখ্যা ৩০০টির কম। হনুমান এ দেশে শুধু লোকালয়ে বেঁচে আছে এবং দিনে দিনে নানা কারণে এদের সংখ্যা কমছে।