ভুটানের জিগমে দরজি জাতীয় উদ্যানের জলপ্রবাহের ধারে কস্তুরা
ভুটানের জিগমে দরজি জাতীয় উদ্যানের জলপ্রবাহের ধারে কস্তুরা

পরিযায়ী পাখি

হঠাৎ দেখা কস্তুরা পাখি 

বর্ষায় দার্জিলিংয়ের রূপ দেখতে ছয়জনের দল ২০১৬-এর জুলাইয়ে কলকাতা গিয়েছি। শিয়ালদহ থেকে সারা রাত ট্রেনে চেপে ভোরে শিলিগুড়ি নামলাম। ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে গাইড গাড়ি ছাড়লেন। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলেছি। চারদিকের দৃশ্য অপরূপ! কোথাও কোথাও মেঘ যেন আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে? ভালো ভিউ পেলেই গাড়ি থামাচ্ছি, ছবি তুলছি। নেপাল সীমান্ত ‘সীমানা’য় পৌঁছানোর পর হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। গাড়ি থেকে নেমে বৃষ্টিতে খানিকটা ভিজলাম। বেশ লাগল। বেলা একটায় ‍বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হোটেল মেঘমায় উঠলাম। দুপুরের খাবার সেরে ‘টিবেতান কালচারাল মিউজিয়াম’-এ গেলাম। সন্ধ্যায় শহরময় ঘুরে বেড়ালাম।

পরদিন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য ভোর পাঁচটায় টাইগার হিলে গেলাম। কিন্তু মেঘ ও ঘন কুয়াশার কারণে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলল না। ওখান থেকে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের বাতাসিয়া লুপে গেলাম। সেখানে পুরো এলাকা একবার মেঘে ঢাকে, তো পরক্ষণেই ফকফকা। ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে সাড়ে সাতটা নাগাদ ঘুম মনাস্টারিতে গেলাম। মাত্র আধা ঘণ্টায় মনাস্টারি ঘুরে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য ঝরনা দেখতে রক গার্ডেনে গেলাম।

রক গার্ডেন এমনিতেই সুন্দর। কিন্তু বিশাল ঝরনা ও তার জলপ্রবাহ গার্ডেনের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়ে ওঠার জন্য ঝরনার চারদিকে চমৎকার রাস্তা। যদিও পাহাড়ি রাস্তা ও সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু ঝরনা ও ফুলের বাগানের সৌন্দর্যে সে কষ্ট ভুলে গেলাম। তবে একটি জিনিসের অভাব বোধ করছিলাম। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় হঠাৎই গাছের ডালে শিস দেওয়া কালচে-নীল দুর্লভ বিহঙ্গের উপস্থিতি সেই অভাবও পূরণ করল। পটাপট ওর কিছু ছবি তুললাম। ফিরতি পথে ঝরনার মাঝখানের বিশাল এক শিলার ওপর পাখিটিকে বসে থাকতে দেখলাম। এবার ওর চমৎকার ছবি পেলাম। দুপুরে একই প্রজাতির আরেকটি পাখি দেখলাম দার্জিলিং চিড়িয়াখানা চত্বরে।

দুই বছর পর আবারও পাখিটিকে দেখলাম ভুটানের জিগমে দরজি জাতীয় উদ্যানের একটি পাথুরে জলধারার পাশে। তবে দেশের মাটিতে দেখতে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হলো। হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের পুণ্যি পুকুরে স্নান করতে আসা পাখিটিকে দেখি ২০২১ সালের ১০ মার্চ বিকেলে।

এতক্ষণ কালচে-নীল দেহের শিস দেওয়া যে পাখিটির কথা বললাম, তা এ দেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি কস্তুরা। অবশ্য এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই ওকে চেনে নীল শিস দামা নামে। কস্তুরা পশ্চিমবঙ্গের নাম। এ ছাড়া অবশ্য পাহাড়ি কস্তুরা, কালজিত বা কলচুরা নামেও পরিচিত। পরিযায়ী হলেও একবার বান্দরবানের আলী কদমে এর একটি বাসা পাওয়া গিয়েছিল। সে কারণেই অনেকে ওকে আবাসিক মর্যাদা দিতে চান। ইংরেজি নাম ব্লু হুইসলিং থ্রাস। গোত্র Muscicapidae, বৈজ্ঞানিক নাম Myophonus caeruleus। বাংলাদেশ ছাড়া এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

কস্তুরার দেহের গড় দৈর্ঘ্য ৩৩ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ১৬৫ গ্রাম। পুরো দেহ উজ্জ্বল কালচে-নীল। কপাল, ডানার পাশ ও লেজ বেশি উজ্জ্বল। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহে উজ্জ্বল রুপালি-নীল তিলা থাকে, যা অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখিতে দেখা যায় না। চোখ কালচে বাদামি। চঞ্চু হলুদ। পা, পায়ের পাতা ও নখ কালো, কিন্তু পায়ের তলা হলদে-ধূসর। স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি ফ্যাকাশে বাদামি-নীল।

পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের রক গার্ডেনে ঝরনার পাশে কস্তুরা

শীতে মূলত চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনের পাহাড়ি ঝরনা, জলধারা ও বৃক্ষবহুল স্থানে দেখা যায়। তবে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের পাতাঝরা বনেও আছে। সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে। পাহাড়ি জলধারার পাশে মাটিতে ঝরাপাতা উল্টে, নরম মাটি গর্ত করে বা অগভীর পানিতে ঠোকর দিয়ে কেঁচো, শামুক, কাঁকড়া, ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ খুঁজে খায়। রসালো ফলেও আপত্তি নেই। ভোরে ও শেষ বিকেলে বেশি সক্রিয়। ভয়ডরহীন পাখিটি গাছের ডালে বসে ‘কি-কি-কি-কি---, ‘ক্রিই---’, ‘টজিট-টজি---’ বা ‘টিইই-টুও-টুও-টিইই- টিইই-টি-টরর-টয়টো---’ স্বরে চমৎকার শিস দেয়।

এপ্রিল থেকে আগস্ট প্রজননকাল। এ সময় জলধারার কাছে পাহাড়ে বা মাটির ফাটলে সবুজ শেওলার ওপর ক্ষুদ্র মূল বিছিয়ে বাটির মতো বাসা বানায়। স্ত্রী তাতে তিন থেকে চারটি ডিম পাড়ে, যা ফুটে ছানা বেরোতে ১৭ থেকে ১৮ দিন সময় লাগে। আয়ুষ্কাল চার বছরের বেশি।

আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়