বন নারাঙ্গা মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ। এটি এক বিরল প্রজাতি। ২০২২ সালের মে মাসে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের সৈয়দপুর গ্রামে প্রথম এই উদ্ভিদের দেখা পাই। প্রকৃতিতে তখন গ্রীষ্মকাল। গিয়েছিলাম এই উপজেলার বাঁশতলী গ্রামে সাদা পাকুড় বৃক্ষ দেখতে।
কালিয়াকৈর বাজারের উত্তর দিকে বংশী নদী। নদী পেরিয়ে পাকা সড়ক ধরে কিছুটা পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলেই সৈয়দপুর গ্রাম। এই গ্রামেই সড়কের ধারে প্রথম বন নারাঙ্গাগাছের সন্ধান পাই।
ঝাঁকড়া গাছের ঝুলন্ত শাখার গায়ে অসংখ্য ফুল ফুটেছিল। দ্বিতীয়বার বিরল এই গাছের সন্ধান পাই চলতি বছরের ১০ মে, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। গ্রীষ্মের প্রখর তাপে ফল পেকে ফেটে যাওয়ার কথা থাকলেও গিয়ে দেখি ফল তখনো পাকেনি। ঝুলন্ত শাখায় পাতার ফাঁকে অনেক কাঁচা ফল ঝুলছিল। কাঁচা ফল সবুজ রঙের। ফল দেখতে পীতরাজ বা রয়নার ফলের মতো।
তৃতীয়বার গত ১২ জুলাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনেই গাছে পাকা, উজ্জ্বল কমলা রঙের ফল দেখি। সারা গাছে তখন একটিমাত্র ফল ছিল। বাকি ফল ঝরে পড়েছিল অথবা কেউ নিয়ে গিয়েছিল হয়তো। কী আর করা। একটিমাত্র পাকা ফলেরই ছবি তুলে ফেলি।
উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম Suregada multiflora। এটি Euphorbiaceae পরিবারের একটি বৃক্ষ। বন নারাঙ্গা ছাড়াও বাংলায় ফাটাগোটা, ফাটা কদম, তেলকাঁকড়া, শ্যামলোকশ্রী ইত্যাদি নামে বৃক্ষটি পরিচিত। ইংরেজিতে পরিচিত ফলস লাইম ট্রি, গোট ট্রি নামে।
এই গাছ ৩ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। কাণ্ড মসৃণ। কাণ্ডে রং ধূসর-হলুদ বা ধূসর-বাদামি। পত্রবিন্যাস একান্তর। পাতা ১৫ থেকে ২২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা। দেখতে গাঢ়-সবুজ, আয়তাকার বা বল্লমাকার। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত ফুল ফোটে। পুরুষ ও স্ত্রী ফুল একই উদ্ভিদে পৃথকভাবে উৎপন্ন হয়। ফুল খুব ছোট, ৫ থেকে ৮ মিলিমিটার লম্বা। পুরুষ ফুল হলদেটে, পুংকেশর ৪০ থেকে ৬০টি। পুরুষ ফুল স্ত্রী ফুলের চেয়ে সামান্য বড়। বৃতি স্থায়ী, অর্থাৎ ফল হওয়ার পর বৃতি ফলের সঙ্গে থেকে যায়। স্ত্রী গাছে ফল হয়। ফল তিন খণ্ডবিশিষ্ট। কিছুটা মাংসল। খোসা শক্ত। ফলের ভেতর বীজ থাকে তিনটি।
বন নারাঙ্গার আদি নিবাস গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এশিয়া। উত্তর–পূর্ব ভারত থেকে চীন, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই বৃক্ষের দেখা পাওয়া যায়। বন নারাঙ্গা একদা আমাদের দেশে বাড়ির আশপাশের প্রাকৃতিক বন জঙ্গলে বেশি দেখা গেলেও এখন খুব একটা দেখা যায় না। বগুড়া, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছু কিছু গাছ দেখা যায়।
গ্রীষ্মকালে ফল পাকলে ফেটে যায়। তাই কোথাও কোথাও একে বলে ফাটা কদম। গ্রীষ্মকালে ফল ফেটে গেলে ভেতর থেকে সাদা বীজ বের হয়। পাখিরা এই বীজ খেতে পছন্দ করে। ফল খাওয়ার যোগ্য নয়।
বন নারাঙ্গার মুকুল থেকে হলুদ রঙের গালা বা লাক্ষা পাওয়া যায়। এর অনেক ভেষজ গুণও রয়েছে। উদ্ভিদের পাতায় আছে ক্ষারক, ফ্লাভোনয়েডস, স্যাপোনিনস, স্টেরয়েড ও ট্যানিন। বাকলে ছত্রাকবিরোধী, জীবাণুনাশক ও অ্যালার্জিরোধী উপাদান রয়েছে। মূল ও কাণ্ডের বাকল থেকে হুকওয়ার্মজনিত কৃমিরোগের ওষুধ তৈরি হয়। মূল বা শিকড় মূত্রবর্ধক। গনোরিয়া, পেটব্যথা, বুকব্যথা, হার্নিয়া, ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, শোথ, চিকেন পক্সসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এই উদ্ভিদের ব্যবহার রয়েছে। বাতের চিকিৎসায় শরীরের আক্রান্ত অংশে বন নারাঙ্গার পাতার পেস্টের প্রলেপ দেওয়া হয়। জ্বরে ও পাকস্থলীর সমস্যায় এই উদ্ভিদের বাকলের রস খাওয়া হয়।
চয়ন বিকাশ ভদ্র: অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ