পাখি

ভরত পাখির গান

ভরত পাখি
ছবি: মনিরুল এইচ খান

নিরিবিলি খোলা মাঠটির ঘাসবনের ভেতর থেকে যেন ছিটকে ওপরে উঠল ছোট পাখিটি। কণ্ঠে মিষ্টি-মোলায়েম ও সুরেলা গান, পাখা কাঁপাচ্ছে-ঝাঁকাচ্ছে অতি দ্রুত তালে, খাড়া ৯০ ডিগ্রি কোণে ছন্দায়িত ভঙ্গিতে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, সুনসান পরিবেশের জন্য মিহি গলার গানটা বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

নজর ওটার নিচের দিকে, শূন্যে যেন ধ্রুপদি নৃত্যে মেতেছে, ক্রমে উঠে গেল প্রায় ৭০ ফুট উঁচুতে, তারপর একই ভঙ্গিতে সরলরেখায় নামতে নামতে আনুমানিক ৩০ ফুট উঁচুতে পৌঁছে হঠাৎ পাখায় যেন ব্রেক কষল।

তারপর পাখা মেলে রেখেই অনেকটা ঝরাপাতার মতো বাতাসে তেরছাভাবে কিছু দূর ভেসে গিয়ে আবারও ব্রেক কষল মাটি থেকে ফুট তিনেক ওপরে। দু-একটি পাক খেয়েই টুপ করে নেমে পড়ল খেতের ঘাসের ভেতর।

বোশেখের বিকেলে এই পাখি যে সুমধুর গান গাইতে গাইতে ওপরে উঠল ও নামল, তার কারণ, ওটার বুকভরা এখন ম–ম ভালোবাসা, প্রেমিকা তো মাঠের ভেতরে ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে। ‘কত ভালোবাসি তোমাকে’ দেখানোর জন্যই তো নৃত্যগীতের এতটা কসরত। শিল্পিত-দর্শনীয় ও মনোমুগ্ধকর নৃত্যগীত ও কণ্ঠের ‘ঝিরিঝিরি, ছি ছি ছিপ, টিহি টিহি’ মিহি সুরেলা গানের দৃশ্য শৈশব-কৈশোর ও তরুণবেলায় বহুবার দেখেছি, সর্বশেষ দেখেছি গত আগস্টে।

১৯৯৬ সালে আমার আমন্ত্রণে পরমাণুবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. রেজাউর রহমান ও আ ন ম আমিনুর রহমান বাগেরহাটের ফকিরহাটে আমার গ্রামে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখেছিলেন, দেখেছিলেন চওড়া আইলের ভেতরের বাসার চারটি নেংটুপুটু ছানাকেও। এই পাখিদের বাসা-ডিম-ছানা তোলার ভরা মৌসুম গ্রীষ্ম-শরৎকাল।

এই যে শূন্যে উড়ে বা শূন্যে উঠে বাতাসে অতি দ্রুতবেগে দুই পাখার বইঠা দ্রুতবেগে চালাতে চালাতে গান গেয়ে চলা, বাসা বানানোর কাজ শেষ হলে, বাসায় ডিম হলে এবং বাসায় ফুটফুটে ছানা হওয়ার উদ্‌যাপনটাও পুরুষ পাখিটা একইভাবে করে।

খোলা মাঠ তথা মুক্ত এলাকা, শুকনা মাঠ-ঘাট-খেতখামার, খেতের চওড়া চওড়া আল, নদী-হাওরের পারের বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা হলো এই পাখিদের মূল চারণক্ষেত্র। সারা বাংলাদেশেই আছে।

দিনের অধিকাংশ সময় মাটির ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে আর হেঁটে খায় নানান রকম কীটপতঙ্গ, কেঁচো, ঘাসবীজ ও অন্যান্য শস্যবীজ। পিঁপড়ার রসাল ডিম ও উইপোকা পেলেও মজা করে খায়। মাঠের মাটিতে বা ধুলায় মাটিস্নান-ধুলাস্নানও করে। শীতের দিনে ডানা মেলে কাত হয়ে আয়েশ করে রোদ পোহায়। ঘাসের পাতা-ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুও পান করে, শিশিরস্নানও করে।

পাখিটির নাম ‘ভরত’। মাথার তালু-ঘাড়-পিঠজোড়া গাঢ় বাদামি রেখা টানা, বুক-পেট লালচে-পীতাভ, বুকে কিছু বাদামি ছোপ, ডানার কিনারা লালচে বা পোড়া ইটের গুঁড়ার মতো লাল। ধূসর ঠোঁট, গোলাপি পা।

ইংরেজি নাম বেঙ্গল বুশলার্ক। বৈজ্ঞানিক নাম Mirafra assamica। দৈর্ঘ্য ১৪ সেন্টিমিটার। মাটির ওপরের সামান্য গর্ত বা খোঁদলে, চওড়া চওড়া আলের ভেতর বা ঘাসের গোড়ায় ঘাসপাতা দিয়ে গোলাকার বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে তিন থেকে পাঁচটি। ডিম ফুটে ছানা হয় ১০ থেকে ১৪ দিনে।

শরীফ খান, পাখি বন্য প্রাণিবিষয়ক লেখক