
সমুদ্রের গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে মহেশখালীর মাতারবাড়ীর বেড়িবাঁধসংলগ্ন জনপদ। বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব শত শত পরিবার।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘেঁষে সায়রার ডেইল এলাকার বেড়িবাঁধ। এই বেড়িবাঁধসংলগ্ন সমুদ্রসৈকতজুড়ে বিধ্বস্ত জনপদের চিহ্ন। কোথাও জোয়ারের তোড়ে ভেসে যাওয়া ঘরের ভাঙা দেয়াল, কোথাও ঢেউয়ের আঘাতে ধসে পড়া গাছের গুঁড়ি। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় আড়াই কিলোমিটার সৈকতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের তাণ্ডব। গত কয়েক বছরে এভাবে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে এ গ্রামের প্রায় ৬০০ বাড়িঘর।
বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে কথা হয় এলাকার বাসিন্দা মো. ইউছুপের সঙ্গে। সমুদ্রের দিকে আঙুল উঁচিয়ে ইউছুপ চেষ্টা করলেন ভেসে যাওয়া তাঁর বাড়ির জায়গাটি শনাক্ত করতে। তিনি বলেন, ‘২০২৩ সাল থেকে সমুদ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল। অনেকের বাড়িঘর ভেসে যাচ্ছিল। ভেবেছিলাম আমার বাড়ি পর্যন্ত আসবে না।’
কিন্তু সেই ভাবনা মিথ্যা হয়ে গেল পরের বছর বর্ষায়। সমুদ্রের এতটাই কাছে চলে এল যে রাতে ঘুমানোর সময় সমুদ্রের গর্জনে মনে হতো ঢেউ গায়ে এসে পড়ছে। এরপর আর দেরি করেননি। ঘরের আসবাব, জিনিসপত্র যতটা সম্ভব সরিয়ে বউ আর তিন সন্তান নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নেন। এর দুই দিনের মধ্যেই ঘর ভেসে যায় সমুদ্রে। বেড়িবাঁধটির টিকে থাকা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
এই সমুদ্রে কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনবার ঘর হারিয়েছেন আবদুল মালেক (৪৫)। চতুর্থবারের মতো যে ঘর তিনি নির্মাণ করেছেন, সেটাও যেকোনো সময় সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছেন তিনি।
এ বছরের জুলাইয়ে নিজের বসতভিটায় বসে মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কৈশোরে বেড়িবাঁধ থেকে সমুদ্র কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ছিল। সমুদ্রের ভাঙনে তিন-তিনবার বসতভিটা হারিয়েছি আমরা। বর্তমান বসতভিটাও সমুদ্রের ভাঙন থেকে রক্ষা পাবে বলে মনে হয় না।’
মালেক বলেন, ‘ভাঙনের কারণে সরে আসতে আসতে এখন বেড়িবাঁধের গোড়ায় এসে ঘর বেঁধেছি। গত বছর সমুদ্রের জোয়ার ঘরের দেয়াল পর্যন্ত চলে আসে। দিন দিন সমুদ্রের তেজ বাড়ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি পাড়া সমুদ্রে বিলীন হয়েছে।’
স্থানীয় লোকজন বলছেন, পাঁচ বছর ধরে প্রায় ৬০০ পরিবার সমুদ্রের ভাঙনে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সাগরে তলিয়ে গেছে জালিয়াপাড়া ও বাহারপাড়া।
উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে
উত্তর সায়রার ডেইল এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেড়িবাঁধ থেকে সমুদ্র ছিল অনেক দূরে। গত কয়েক বছরে সমুদ্রের জোয়ারের তীব্রতা বেড়েছে। আগে স্বাভাবিক যে জোয়ার ছিল, এখন তার চেয়ে তিন-চার ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ার দেখা যায়।
২০২৪ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে ১৯৯৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর বেড়েছে গড়ে ৫ দশমিক ৮ মিলিমিটার, যেখানে বৈশ্বিক গড় ৩ দশমিক ৮ মিলিমিটার।
‘এসটিমেশন অব সি লেভেল রাইজ (এসএলআর) ইন বাংলাদেশ ইউজিং স্যাটেলাইট অলটিমেট্রি ডেটা’ শীর্ষক এ গবেষণা করেছে বুয়েটের পানি ও বন্যাব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট (আইডব্লিউএফএম)।
অলটিমেট্রি ডেটা ব্যবহার করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া-কমার হিসাব করা যায়। এটি এমন এক উপাত্ত, যা স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত রাডার সংকেত বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর পৃষ্ঠ (বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠ) থেকে স্যাটেলাইটের দূরত্ব নির্ধারণ করে।
আইডব্লিউএফএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্যাটেলাইট অলটিমেট্রি পদ্ধতি মহাকাশ থেকে পানির স্তর পরিমাপ করে সমস্যার খুব ভালো সমাধান দিতে পারে। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ১৯৯৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গঙ্গার উপকূলীয় প্লাবনভূমি, মেঘনা মোহনার প্লাবনভূমি ও চট্টগ্রাম উপকূলের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের (আইডব্লিউএফএম) অধ্যাপক ও জলবায়ুবিষয়ক জাতিসংঘের আন্তসরকার প্যানেল আইপিসিসির লেখক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অ্যান্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড ও দক্ষিণ মেরুতে বরফ গলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতায় তাপমাত্রা বেড়ে পানিতে থার্মাল এক্সাপানশন (তাপীয় সম্প্রসারণ) হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াকে মোদ্দা কথায় বলা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি।
গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, এ উচ্চতা বাড়তে থাকবে। একই সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারের তীব্রতা বাড়তে থাকবে। উপকূলে পানির ধাক্কাও বেশি হতে থাকবে। এর ফলে উপকূলে ভাঙনও বাড়বে। এর প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গা পানিতে ডুবে যাবে, এমন শঙ্কার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা এমন নয় যে এক দিনে সব ভেঙে যাবে। প্রক্রিয়াটা ধীরগতির। যে পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে এ শতাব্দী শেষে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার (৩ দশমিক ২৮ ফুট) বেড়ে যাবে।
এ সংকটের মধ্যে আরেকটা সংকট আবির্ভূত হচ্ছে জানিয়ে সাইফুল ইসলাম বলেন, উপকূলে বাঁধের কারণে পলি জমা হতে না পেরে ভূমি দেবে যাচ্ছে। ভূমির সাবসিডেন্স (ভূমি দেবে যাওয়া) আরেকটি সংকট। একদিকে ভূমি দাবছে, অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এটাকে বলা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠের আপেক্ষিক উচ্চতা বৃদ্ধি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের উপকূলে জনসংখ্যা চার কোটির বেশি, যারা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক থেকে দেড় মিটার উচ্চতায় বসবাস করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা সামান্য বাড়লেও উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে।
সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে জোয়ারের তীব্রতা বেড়ে ‘এসটিমেটিং ভার্টিক্যাল লং মোশন-অ্যাডজাস্টেড সি লেভেল রাইজ ইন ডেটা স্পার্স অ্যান্ড ভালনারেবল কোস্টাল রিজিয়ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা করে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়।
এ গবেষণায় দেশের উপকূলকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে—পূর্ব, মধ্য ও পশ্চিম উপকূল। পূর্বাঞ্চলের উপকূল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র এলাকায় প্রতিবছর জোয়ারের উচ্চতা বাড়ছে ৬ দশমিক ২৩ মিলিমিটার। মধ্যাঞ্চলে এই বৃদ্ধি ১ দশমিক ৪৯ মিলিমিটার এবং পশ্চিমাঞ্চল হিসেবে বিবেচিত সুন্দরবন এলাকায় বাড়ছে ২ দশমিক ৪ মিলিমিটার হারে।
জানতে চাইলে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটরি সায়েন্সের গবেষণা পরিচালক আশরাফ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত কক্সবাজারে উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। এই যে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিশাল সব অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে, এর ফলে ভূমির ব্যবহারের ধরন পাল্টে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের মাটি পলিবাহিত মাটি। ফলে এ বিশাল অবকাঠামোর চাপে ভূমি অবনমন হচ্ছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়নজনিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় পূর্বাঞ্চলের উপকূলে ঝুঁকি বেড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কক্সবাজার জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মাতারবাড়ী ও ধলঘাট এলাকায় তাঁদের বেড়িবাঁধের মোট দৈর্ঘ্য ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার বাঁধ। বাকি ১৮ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত করা দরকার।
নুরুল ইসলাম বলেন, গত অর্থবছরে জিও ব্যাগ দিয়ে ৮২৯ মিটার দৈর্ঘ্যে ভাঙন ঠেকানোর কাজ করেছে পাউবো। সমুদ্রের তীব্রতায় সেটা বেশি দিন টিকিয়ে রাখা কঠিন।
উন্নয়ন প্রকল্পে হারিয়েছে জীবিকা
মাতারবাড়ীকে সিঙ্গাপুরে রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েই মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে বিগত স্বৈরাচারী সরকার। ২০১২ সালের দিকে মাতারবাড়ীর জনজীবনে ভূমি অধিগ্রহণের প্রভাব কেমন ছিল, তা নিয়ে গবেষণা চালায় উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড। তাদের গবেষণায় বলা হয়, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৯০ হাজার মানুষ।
মাতারবাড়ীতে মোট জনসংখ্যা ১ লাখের মতো। অধিগ্রহণ করা হয় ২ হাজার ৮৮০ একর লবণমাঠ। লবণচাষি, চিংড়িচাষি, মাছ ও কাঁকড়াচাষিসহ মোট ২০ হাজার মানুষ এ প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ইউনিয়নে ভূমি আছে মাত্র ২৭ বর্গকিলোমিটার, সঙ্গে ৪ বর্গকিলোমিটার বনভূমি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে এখন প্রতি বর্ষায় ২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয় বলে একশনএইডের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২২ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে মূল সড়কের যোগাযোগ স্থাপন করতে ১৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কুহেলিয়া নদীর অংশ দখল করে সড়ক ও জনপথ নির্মাণ করেছে সাড়ে ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি সড়ক। সড়কটি নির্মাণ করতে গিয়ে কুহেলিয়া নদীর ২৬ একর জায়গা ভরাট করা হয়।
এখানকার সিংহভাগ মানুষের জীবিকার উৎস ছিল সচরাচর নদী ও সমুদ্র থেকে চিংড়ির পোনা ধরা, লবণমাঠে শ্রমিক হিসেবে কাজ ও লবণ পরিবহনের কাজ। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে এখানে অধিগ্রহণ করা হয় ১ হাজার ৬০৮ একর জমি, যার পুরোটাই ছিল লবণমাঠ। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে আসা-যাওয়ার জন্য কুহেলিয়া নদীর একাংশ ভরাট করে নির্মাণ করা হয় একটি সড়ক। ফলে লবণ পরিবহন ও চিংড়ির পোনা ধরার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দক্ষিণ সায়রার ডেইল এলাকার রমজান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে কুহেলিয়া নদীতে মাছ ধরতাম। ইচ্ছে হলে লবণমাঠে কাজ করতাম। প্রতিদিন আয় করেছি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ প্রকল্প হওয়ার পর আমাদের সব গেছে। একদিকে সমুদ্রের গর্ভে গেছে বসতভিটা আর প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের পেশা।’
‘এহন আঁরা ন হাইয়া সিঙ্গাপুর’, (আমরা এখন এমন সিঙ্গাপুর যেখানে না খেয়ে থাকতে হয়) বলেন রমজান। তিনি বলেন, প্রকল্প করার সময় সরকার পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কর্মসংস্থান করার কথা ছিল। কেউ কথা রাখেনি।
সায়রার ডেইলের আবদুল খালেক একসময় সমুদ্রতীরের কাছে নিয়মিত মাছ ধরতেন ছোট ডিঙিনৌকা নিয়ে। তিনি বলেন, আগে যাঁরা ছোট ডিঙিতে সমুদ্রতটের আশপাশে মাছ ধরতেন, এখন তা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, সাগরের ঢেউয়ের তীব্রতা বেড়েছে। অন্যদিকে কুহেলিয়া নদীর একাংশ ভরাট করে মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎকেন্দ্রে আসা-যাওয়ার রাস্তা বানানো হয়েছে। তাতে নদী সংকুচিত হয়ে গেছে। এখন আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত চাষি মাতারবাড়ীর জব্বার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে উন্নয়ন প্রকল্প—দুটোই এখন আমাদের জন্য গলার কাঁটা। বিদ্যুৎকেন্দ্রে হারিয়েছি লবণের মাঠ। সমুদ্রে যেকোনো সময় বাড়িঘর চলে যেতে পারে। এ বছর বর্ষায় অন্তত ১০০টি পরিবার বাড়িঘর হারিয়েছে।
জব্বার বলেন, ‘বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সময় পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের বাড়িঘর আর লবণের মাঠ নেওয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি সরকার রক্ষা করেনি। লবণ চাষ ছিল আমাদের বাপ-দাদার আমলের পেশা। সে পেশা এখন ছাড়তে হয়েছে।’
প্রায় ৪ একর জমিতে লবণ চাষ করতেন জব্বার। যা আয় করতেন তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটত। এখন ঘর হারিয়ে সায়রার ডেইলের বেড়িবাঁধে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের পরিদর্শক ইদ্রিছ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ধলঘাটা ও মাতারবাড়ী পাশাপাশি দুই ইউনিয়নে একসময় লবণমাঠ ছিল প্রায় ৬ হাজার একর। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সমুদ্রবন্দর নির্মাণে এখানে অধিগ্রহণ করা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩৬৬ একর লবণের মাঠ।
মহেশখালী উপজেলায় মোট লবণচাষি আছেন ১৪ হাজার। এখানে ১৭ হাজার ৪৪২ একর জমিতে লবণের চাষ হয়। বছরে লবণ উৎপাদিত হয় ৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯০৬ মেট্রিক টন। ১৪ হাজার লবণচাষির পাশাপাশি লবণ চাষে সহকারী হিসেবে কাজ করেন প্রায় ৩০ হাজার। এ বছর লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার টন। ১৭ মে লবণের মৌসুম শেষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ লাখ টন। দেশের সিংহভাগ লবণ উৎপাদিত হয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপজেলায়।
মহেশখালীর মানুষের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষায় আন্দোলন করে আসছেন মহেশখালী জনসুরক্ষা মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মহসিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাতারবাড়ীকে সিঙ্গাপুর বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে এ জনপদের সব সম্পদ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিশ্রুতি ছিল বিদ্যুৎকেন্দ্রে চাকরির ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষদের অগ্রাধিকার থাকবে। কারণ, তাঁরা জমি-জীবিকা হারিয়েছেন। দিন শেষে দেখা গেল, বাইরে থেকে শ্রমিক এনে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ দেওয়া হয়েছে।
যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে মাতারবাড়ীর একাংশ সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে, সেখানে স্থানীয় মানুষের ঐতিহাসিক জীবিকার উৎসগুলো টিকিয়ে রাখা দরকার ছিল। অথচ সেখানে তাঁদের জীবিকার উৎসগুলো কেড়ে নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মহসিন বলেন, এখানে উন্নয়ন মানে সাধারণ মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়। একদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণে সমুদ্রের মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে গিয়ে লবণচাষের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সরকারের উচিত মাতারবাড়ীর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসা।