
পরিবেশ অধিদপ্তর গত রোববার এক পরিপত্রে ঢাকা জেলার সাভার উপজেলাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ এই প্রথম নেওয়া হলো। এই প্রেক্ষাপটে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ কী, কেন কোনো নির্দিষ্ট এলাকাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়, এই ঘোষণার পর কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়—এসব বিষয় আলোচনায় এসেছে।
পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২-এর বিধি ৫-এর ক্ষমতাবলে সমগ্র সাভার উপজেলাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়েছে।
বিধি ৫ অনুযায়ী, কোনো এলাকার বায়ুমান নির্দিষ্ট মানমাত্রা অতিক্রম করে মারাত্মক দূষিত এলাকায় পরিণত হলে এলাকাটিকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা যাবে।
বায়ুদূষণের মাত্রা নিয়মিতভাবে জাতীয় মান অতিক্রম করলে কোনো এলাকাকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার পর এলাকাটিতে বিশেষ পরিবেশ আইন ও বিধি প্রযোজ্য হয়। শিল্পকারখানা ও প্রকল্পে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়।
জারি হওয়া পরিপত্রে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিবীক্ষণ কেন্দ্রগুলোর তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সাভারের বায়ুর বার্ষিক মানমাত্রা জাতীয় বার্ষিক নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় তিন গুণ অতিক্রম করেছে। জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের ওপর এই মাত্রাতিরিক্ত দূষিত বায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় ঢাকা জেলার সাভার উপজেলা মারাত্মক বায়ুদূষণযুক্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় পাঁচ মাস উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিমে বায়ু প্রবাহিত হয়। ফলে সাভার উপজেলায় সৃষ্ট বায়ুদূষণ ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। এটি ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের তীব্রতা অনেক বাড়িয়ে দেয়। ফলে ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের ওপর অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই প্রেক্ষাপটে সাভার উপজেলাকে ডিগ্রেডেড এয়ারশেড ঘোষণা করা হলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাভারকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা দেওয়া একটি সতর্কবার্তা। বায়ুদূষণের কারণে এলাকাটিতে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাভার এলাকায় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এখন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণের একটি বড় উৎস ইটভাটা। ২০২৩ সালে বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের পেছনে ইটভাটা ২৮ শতাংশ দায়ী।
২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে মোট ৭ হাজার ৮৬টি ইটভাটা চালু আছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫০৫ ইটভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের চার বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ অবৈধ ইটভাটা বেড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে প্রায় ১ হাজার অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করলেও সেগুলোর ৭৫ শতাংশই আবার চালু হয়ে গেছে। অবশ্য বেসরকারি পর্যবেক্ষণ বলছে, দেশের বেশির ভাগ ইটভাটা নিয়মবহির্ভূতভাবে চলছে। এসব ইটভাটার কারণে ঘটছে বায়ুদূষণ।
‘টেকসই ইট উৎপাদনে জাতীয় কৌশল’ শীর্ষক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ইট উৎপাদনে নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করা হয়। শুধু ঢাকার চারপাশে থাকা ইটভাটা থেকে বছরে প্রায় ৫৩ হাজার টন অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা-১০ (পিএম ১০) এবং ১৭ হাজার টন পিএম ২.৫ নির্গত হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সাভার উপজেলায় ১০৭টি ইটভাটা আছে। এর মধ্যে মাত্র দুটি ইটভাটায় পরিবেশবান্ধব উপায়ে ইট তৈরি করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণবিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষিত বায়ুতে থাকার কারণে বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রা—প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’ অনুযায়ী, বায়ুদূষণে ২০২৪ সালে দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ দূষিত নগর ছিল ঢাকা।
পরিবেশ অধিদপ্তরে তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে সাভার উপজেলার বায়ুমান ৩৬৫ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন ছিল মানমাত্রা–বহির্ভূত ছিল।
সাভারকে কেন ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা হলো, জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৩ সালে সাভার উপজেলায় ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৬৪ দিনের বায়ু ছিল মানমাত্রা–বহির্ভূত। আর ঢাকার বায়ু মাত্রা–বহির্ভূত ছিল ১৫৬ দিন। পরের বছর ২০২৪ সালে সাভারে দূষিত বায়ুর দিন ছিল ১৪৯ দিন, ঢাকায় ১২৮ দিন।
জিয়াউল হক বলেন, ‘ঢাকা শহরের ছয়টি বায়ুমান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যে আমরা দেখেছি, ঢাকা আর সাভারের বায়ুদূষণ প্রায় সমান। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম। এ সময় উত্তর থেকে দক্ষিণে বাতাস প্রবাহিত হয়। ঢাকা দক্ষিণে হওয়ায় সাভারের দূষণ ঢাকা পর্যন্ত চলে আসে। সে কারণে ঢাকার দূষণও বেড়ে যায়। এ কারণে সাভার উপজেলাকে ডিগ্রেডেড এয়ারশেড ঘোষণা করা হয়েছে।’
বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২-এ বলা আছে, ডিগ্রেডেড এয়ারশেড ঘোষণার পর সংশ্লিষ্ট এলাকার বায়ুমান উন্নয়নের জন্য একটা কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দূষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিতে হবে। এসব ব্যবস্থার ফলে বায়ুমানের উন্নতি হলে দুই বছর পর এই ঘোষণা প্রত্যাহার করা যাবে।
রোববারের পরিপত্র অনুযায়ী, ডিগ্রেডেড এয়ারশেড ঘোষিত সাভারে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বায়ুদূষণ সৃষ্টিকারী কিছু কার্যাবলি পরিচালনা বা সম্পাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ বিষয়গুলো হলো—আগামী সেপ্টেম্বর থেকে সাভার উপজেলার অন্তর্গত সব ধরনের ইটভাটায় (টানেল ও হাইব্রিড হফম্যান কিলন ছাড়া) ইট পোড়ানোসহ ইট প্রস্তুতের কার্যক্রম পরিচালনা। উন্মুক্ত অবস্থায় কঠিন বর্জ্য পোড়ানো। বায়ুদূষণ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে—এমন সব ধরনের নতুন শিল্পকারখানার অনুকূলে অবস্থানগত ও পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান। এই উদ্দেশ্যে প্রণীত কর্মপরিকল্পনায় উল্লিখিত অন্যান্য কার্যাবলি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাভারে নতুন করে বায়ুদূষণ করে—এমন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না। সাভারে ১০৭টি ইটভাটা আছে। সবগুলোই পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হবে। শিল্পকারখানার দূষণ খুব বেশি নেই। উন্মুক্ত বর্জ্য পোড়ানো হয় এখানে। সেটাও বন্ধ করা হবে।
জিয়াউল হক বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আমরা একটা উপজেলা দিয়ে শুরু করলাম। ভবিষ্যতে এ রকম পদক্ষেপের আওতা বাড়বে।’
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমবারের দেশের কোনো একটি এলাকাকে দূষিতবায়ুর এলাকা হিসেবে সরকার স্বীকার করে নিল এই ঘোষণার মাধ্যমে। তিনি এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানান। এখানে তিনটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে—ইটের ভাটার অনুমোদন না দেওয়া। বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করা। দূষণকারী প্রতিষ্ঠান অনুমোদন না দেওয়া। এখন পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে যে চ্যালেঞ্জ, সেটি সরকারকে নিতে হবে।