১৭৮৭ সালের এক মহাপ্লাবনে বর্তমান তিস্তা নদীর সৃষ্টি। এরপর ২৩৮ বছরে এ নদীতে কত প্রজাতির পাখি এসেছে, এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। ১৫ বছর ধরে আমি তিস্তা নদীর সুরক্ষা নিয়ে কাজ করলেও গত ৮ বছর ধরে ক্যামেরা নিয়ে তিস্তায় যাওয়া-আসা।
যতই দিন যাচ্ছে, তিস্তা নদীতে নতুন নতুন প্রজাতির পাখির সন্ধান পাচ্ছি। এখানে পাখির বৈচিত্র্য দেখে বিস্মিত হচ্ছি।
গত পাঁচ-ছয় বছরে রংপুরে আমরা পাঁচ-ছয়জন পাখির ছবি তুলি। কেবল তিস্তায় নয়, রংপুরে কী কী প্রজাতির পাখি দেখা যায়, তারও একটি ধারণা পাওয়া যায়।
তিস্তা নদী ও এর চরে যেসব প্রজাতির পাখি দেখেছি, তার সংখ্যা শতাধিক। তিস্তায় মাছমুরাল, লম্বা পা তিশাবাজ (প্রজাপতি বাজ) সব সময় থাকে। এ পাখি দুটি সারা দেশে খুব যে সহজলভ্য, তা নয়। দুই প্রজাতির পানকৌড়ি দেখা যায়। বাবুবাটান থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে।
এই ঝাঁকের ভেতরে কখনো কখনো বড় বাবুবাটানও দেখা যায়। নদীতে বাবুবাটানের ওড়াউড়ি দৃষ্টিনন্দন। শালিক পাখির চেয়ে সামান্য ছোট এ পাখির ডানা তুলনামূলক বেশ লম্বা। অগণিত মালাচ্যাগা রয়েছে। মালাচ্যাগার চোখ দৃষ্টিকাড়া। এ ছাড়া অনেক প্রজাতির চাপাখি দেখা যায়। লাল পা পিউ, সবুজ পা পিউ তিস্তায় চোখে পড়বে। এগুলো ৮০ থেকে ১০০টি একসঙ্গে দেখা যায়। লাল-লতিকা ও ধূসর-মাথা হট্টিটি আছে অগুনতি। এরা দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে।
গাঙ টিটিও চোখে পড়ে কখনো কখনো। সংখ্যায় কম। তিস্তায় সাবাজ টিটি পাওয়া যাবে, কখনো তেমন মনে হয়নি। একদিন লম্বা পা তিশবাজের ছবি তুলছিলাম, এমন সময় দেখি দূরে একঝাঁক পাখি উড়ছে। ক্যামেরায় জুম করেও ভালো বোঝা গেল না। নৌকায় করে এগিয়ে গিয়ে দেখি একঝাঁক সাবাজ টিটি। গত দুই বছর আমরা এ পাখির ঝাঁক পেয়েছি। সাবাজ টিটি পাখি দেশে বেশ দুর্লভ।
চখাচখি পাখি আছে। শাহচখাও সহজলভ্য। প্রতিবছর ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। কিন্তু শাহচখা আসে খুব কম। নৌকার মাঝির বর্ণনামতে বুঝতে পেরেছি, একবার একটি বিশাল ঝাঁক এসেছিল। আমরা দুটি–একটি করে অনেকবার দেখেছি।
তিস্তায় বিভিন্ন ধরনের পরিযায়ী হাঁস দেখা যায়। পিয়ং হাঁস, লালশির বা সিঁথি হাঁস, কড় রাজহাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, নাইরলি হাঁস, রাঙা দিঘেরি, ঘড়ঘড়ি হাঁস, সোনা দিঘেরি আসে। রাঙ্গামুড়ি হাঁস দেখেছি অনেকবার।
কালোমাথা কাস্তেচরা ও চকচকে কাস্তেচরা দেখেছি তিস্তায়। বড় খোঁপা ডুবুরি, ছোট খোঁপা ডুবুরি ও লাল-ঘাড় ডুবুরির দেখা পাওয়া গেছে এ নদীতে। কালো মানিকজোড় দেখেছি কয়েকটি। বহেরি বাজ নিয়মিত আসে তিস্তায়। তুরমুত বাজও আসে। জাপানি বা পাতি বাজ নিয়মিত দেখা যায়। ছোট দস্যু ইগল দেখেছি একবার। নেপালি ইগলও নিয়মিত আসে। তিস্তায় নেপালি ইগল পাওয়া একটি বড় ঘটনা। শ্বেজলেজি ইগলও দেখা গেছে তিস্তায়। সরু-চঞ্চু ডুবুরি হাঁস তিস্তায় কয়েকবার দেখা গেছে। এই হাঁসের মতো বিরল পাখি তিস্তায় দেখা বড় আনন্দের। কয়েক প্রজাতির গাঙচিল, চাপাখি, গঙ্গা কৈতর দেখা যায়। প্রায় ২০টি ধূসর বকের ঝাঁক দেখেছি একবার।
তিস্তায় যে পাখিগুলো দেখা যায়, তার অধিকাংশই শীতকালে আসে। এগুলোর মধ্যে যেমন আছে আবাসিক পাখি, তেমনি পরিযায়ী পাখি। আশা করি, তিস্তায় আসা পাখি প্রজাতিগুলোর মোটামুটি একটি ধারণা হাজির করতে পেরেছি। তিস্তায় আগামী সময়ে আরও নতুন নতুন কিছু পাখি দেখতে পাব বলে আশা করি। বিশেষ করে সোনাজঙ্ঘা ও তুলোগলা মানিকজোড় দেখার আশা রাখি। আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিযায়ী হাঁসও দেখা যেতে পারে।
তুহিন ওয়াদুদ, শিক্ষক, নদীগবেষক ও সংগঠক