গত ৬ মে ২০২৫ বিকেলে হাঁটতে গিয়েছিলাম ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উদ্যানে। ফেরার পথে সার্কিট হাউস মাঠের পূর্ব পাশের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের গেট দিয়ে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (পুরুষ) ক্যাম্পাসে ঢুকলাম। বিশাল তেঁতুলগাছের পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পৌঁছে গেলাম আলেকজান্ডার ক্যাসলের পাশে। ১৮৭৯ সালে মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য ৯ একর জমির ওপর এই বাগানবাড়ি নির্মাণ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহ সফরকালে আলেকজান্ডার ক্যাসলে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। এ ছাড়া আরও অনেক অনেক বরেণ্য মানুষই এই ক্যাসলে রাত কাটিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, লর্ড কার্জন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, স্যার সলিমুল্লাহ, ওয়াজেদ আলী খান পন্নী। আলেকজান্ডার ক্যাসলের সামনের ঘাসে ঢাকা মাঠকে বাঁ পাশে ফেলে এগিয়ে গেলেই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভবন। এই ভবনের সামনে চোখে পড়ল ফুলে ফুলে ভরা রক্তকরবীগাছ। ছবি তুলে ফেললাম ঝটপট।
রক্তকরবী একটি লাল বা গোলাপি ফুলবিশিষ্ট চিরহরিৎ গুল্ম। এর বৈজ্ঞানিক নাম Nerium oleander, এটি Apocynaceae পরিবারের উদ্ভিদ। ইংরেজিতে এই গুল্ম Oleander, Nerium ইত্যাদি নামে পরিচিত। গাছ সাধারণত গোড়া থেকে ওঠা বেশ কটি ডালের একটি ঝোপ তৈরি করে। ডালের ওপরের দিকে পাতা থাকে আর থাকে পাঁচ পাপড়ির ফুল। প্রায় সারা বছরই ফুল ফোটে। এর পাতা সরু ও লম্বাটে। করবীর ফুল বাইরের দিকে ফোটে। প্রান্তিক ও ঘন। এর ফল ডিম্বাকার ও শাখা-প্রশাখার অগ্রভাগে ফুল ধরে। ফল শাঁসযুক্ত হয়। ফল কাঁচা সবুজ, পাকলে হয় ধূসর রঙের। সাধারণত ফুল সতেজ থাকে চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত।
এই গাছ ২ থেকে ২ দশমিক ৫ মিটার উঁচু হতে পারে। গোড়া থেকে বেশ কটি ডাল ঝোপের মতো গজায়। পাতা ডালের আগার দিকে বেশি। গ্রীষ্ম ও বর্ষায় ফুল ফোটে। কলমে চাষ হয়। ছাঁটার প্রয়োজন হয় না। এদের বীজ বিষাক্ত। এই উদ্ভিদ তাপ ও খরাসহিষ্ণু । রক্তকরবী দেখতে সুন্দর। অত্যন্ত রুক্ষ পরিবেশে বাড়তে পারে বলে আলংকারিক উদ্ভিদ হিসেবে বাগানে, রাস্তার পাশে লাগানো হয়। কিন্তু গাছের মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল, ফল, বীজ—সবই বিষাক্ত। কারণ, এই গুল্মে ওলিয়েন্ড্রিন ও ডিজিটক্সিজেনিন নামের বিষাক্ত কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইড থাকে। তা ছাড়া এ উদ্ভিদে থাকা উল্লেখযোগ্য রাসায়নিক যৌগ হচ্ছে টারপিনয়েড, ফ্ল্যাভোনয়েড, ফেনল, অ্যালকালয়েড ইত্যাদি।
এই রাসায়নিক দ্রব্যগুলো উদ্ভিদের সারা দেহে থাকে, তবে মূল ও বীজে থাকে উচ্চমাত্রায়। একটিমাত্র পাতা খেলেই মানুষের, বিশেষ করে শিশুর মৃত্যু হতে পারে। এই উদ্ভিদের কাণ্ড বা পাতার রস ত্বকে লাগলে ফুসকুড়ি হয়। ঘাসে মিশে যাওয়া শুকনো রক্তকরবী পাতা খেলেও গবাদিপশুর মৃত্যু হতে পারে। ২০০২ সালে আমেরিকায় ৮৪৬টি বিষক্রিয়ার ঘটনা রেকর্ড করা হয়। যার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ বিষক্রিয়ার কারণ ছিল রক্তকরবী। এর ফুলে কোনো মধু থাকে না কিন্তু কিছু পোকামাকড় এর পাপড়ির সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ফুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই এ ফুলের পরাগায়ন হয়।
এই উদ্ভিদের কিছু ভেষজ গুণ রয়েছে। অকালে চুল পাকা কমাতে করবীর মূলের ছাল উপকারী। খোসপাঁচড়া সারাতে এর মূল তিল বা নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে মাখতে হবে। ব্রণ কমাতে মূলের ছাল উপকারী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কবিতায় লিখেছেন,
‘যখন বিদায়-বাঁশির সুরে সুরে
শুকনো পাতা যাবে উড়ে
সঙ্গে কে র’বি।’
‘আমি রব, উদাস হব ওগো উদাসী,
আমি তরুণ করবী।’
ফুলের আদি বাসস্থান দক্ষিণ আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আবার কারও মতে, এই উদ্ভিদের আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ। বর্তমানে এটি থাইল্যান্ড, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কিছু এলাকাজুড়ে দেখতে পাওয়া যায়।
চয়ন বিকাশ ভদ্র, অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজ, ময়মনসিংহ