খুলনার খালিশপুরে রূপসা-ভৈরব-আতাই—তিন নদ–নদীর মিলনস্থলে দেখা গেছে একটি শুশুক
খুলনার খালিশপুরে রূপসা-ভৈরব-আতাই—তিন নদ–নদীর মিলনস্থলে দেখা গেছে একটি শুশুক

মিঠাপানির ডলফিন দিবস

খালিশপুরের মিঠাপানির শুশুক

মাত্র ৭ মিনিটে প্রায় ২৬ বার ডলফিনের দেখা পেলাম। এত কম সময়ে একসঙ্গে এতবার ডলফিনের দেখা এর আগে কখনো পাইনি। খুলনা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রূপসা নদীর শেষ মাথায় আরও দুটি নদ এসে মিলেছে। একটির নাম আতাই, অন্যটি ভৈরব নদ। এলাকাটির নাম খালিশপুর। এই তিন নদ–নদীর মিলনস্থনে ৭-১০টি ডলফিনের একটি দল আছে। যেকোনো সময় ওই মোহনায় গেলেই ডলফিনের দেখা মেলে। ছোট একটি নৌকায় বসে যেদিকেই তাকাবেন, সেদিকেই এদের দেখা মিলবে।

সাধারণত প্রতিটি ডলফিন তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির ওপর ভেসে ওঠে। তাই ঘন ঘন ডলফিনের দেখা মেলে। এখানকার ডলফিন প্রজাতিটির নাম গ্যানজেস রিভার ডলফিন, যাকে বাংলায় বলে শুশুক। আইইউসিএনের লাল তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বিপন্ন প্রজাতির এই মিঠাপানির ডলফিন প্রজাতিটি এ দেশের বিভিন্ন নদীতেও দেখা যায়।

খালিশপুরে গত চার বছরে এই শুশুকগুলোকে গণনা করতে সেখানে ১৬ বার গিয়েছি। সর্বশেষ গেলাম মাস দুয়েক আগে। অসাধারণ সব অনুভূতি। শুশুকগুলোকে যতবারই দেখি, মনে হয় সব কটিই আমার চেনা। মা শুশুকের সঙ্গে যখন দেখি বাচ্চাগুলোও লাফ দেয়, সেই দৃশ্য দেখার অনুভূতি আরও বিরল। খালিশপুরের এই জায়গা ডলফিনের ভালো আবাসস্থল বলে এখানে তারা বাচ্চাও দেয়। বাচ্চাগুলো বড় হলে তারা আবার অন্য নদীর মোহনায় চলে যায় কি না, তা আমাদের জানা নেই।

খালিশপুরে শুশুকগুলোর সহজে দেখা পেয়ে সব সময়ই ভালো লাগে। মনে হয়, এত ছোট একটি জায়গায় কেন বারবার শুশুক পানির ওপর ভেসে ওঠে। শুশুকগুলোর ঘন ঘন ভেসে ওঠার বড় কারণ হলো নদীদূষণ বা এই নদীর পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা তুলনামূলক কম। তাই এদের বেশি বেশি পানির ওপর উঠতে হয়। এই মোহনায় একসঙ্গে ডজনখানেক বড় জাহাজ নোঙর করাও থাকে। সব মিলিয়ে খালিশপুরে শুশুকের দেখা মিললেও তারা এখানে খুব ভালো আছে বলে মনে হয় না।

শুধু খালিশপুরেই নয়, এ দেশের প্রায় সব মিঠাপানির নদীগুলোতেই একসময় শুশুকের দেখা মিলত। এখন এই সংখ্যা কমে গেছে। সারা দুনিয়ায় এই জাতের ডলফিন টিকে আছে পাঁচ হাজারের মতো। এ দেশে দেখা যায় তার প্রায় অর্ধেক। গত বছর বন অধিদপ্তর ও ডব্লিউসিএস বাংলাদেশের উদ্যোগে এ দেশের নদীগুলোতে প্রায় ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটারে শুশুকের গণনা হয়েছে। মূলত এ গণনা হয়েছিল মেঘনা, পদ্মা আর যমুনা ও এর কিছু কিছু শাখা নদীতে। তাদের এ গণনায় দেখা মিলেছে প্রায় ৬৩৬টি শুশুকের দল। এসব দলে শুশুকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩৫২। এ বছর আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার গণনা করা হয়েছে। শুশুক গণনার ফলাফল আমরা শিগগিরই পাব।

বাংলাদেশে সাত জাতের ডলফিন ও এক জাতের পরপয়েস দেখার তথ্য আছে। এর মধ্যে প্রকৃত মিঠাপানির নদীর ডলফিনই হলো এই শুশুক। শুশুক ছাড়াও ইরাবতী ডলফিন নামের আরেক জাতের ডলফিন আছে, যা আমাদের উপকূল অঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। অনিয়মিতভাবে মাঝেমধ্যে মিঠাপানির নদীতে চলে আসে। গত চার বছরে খালিশপুরে আমি মাত্র একবার দুটি ইরাবতী ডলফিন দেখেছি।

অন্য যেকোনো জলজ প্রাণীর চেয়ে শুশুক খুবই বুদ্ধিমান। এরা স্তন্যপায়ী হওয়ায় সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে এবং বাচ্চা লালন–পালন করে। দিন-রাতের মাত্র ১৫-২০ মিনিট এরা ঘুমায়। এ সময়ও মস্তিষ্কের অর্ধেকটা অংশ বিশ্রাম নেয়। শরীরের অন্যান্য অংশ সচল থাকে।

আমাদের দেশের নদীগুলো শুশুকের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল হলেও প্রাণীটি সংরক্ষণে খুব বেশি উদ্যোগ নেই। এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এ দেশে যত শুশুক মারা পড়ে, তার প্রায় ৭৯ শতাংশই নিষিদ্ধ কারেন্ট জালে আটকা পড়ে। নদীমাতৃক এই দেশে ডলফিন সংরক্ষণে মাত্র ৯টি অভয়ারণ্য ঘোষণা করলেও তা কার্যকরভাবে সংরক্ষণে সফল হয়নি। ২৪ অক্টোবর বিশ্ব মিঠাপানির ডলফিন দিবস। আমাদের দেশে দিবসটি জাতীয়ভাবে পালিত হচ্ছে আজ। নদীপ্রাণ শুশুককে ‘জাতীয় জলের প্রাণী’ হিসেবে ঘোষণা করার দাবি আমাদের সব সময়ের। জলজ প্রাণীটি রক্ষায় সবারই দায়িত্ব নিতে হবে।

সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক