ভারতের জাতীয় পতাকা
ভারতের জাতীয় পতাকা

বিশ্লেষণ

আ.লীগ নির্ভরতা থেকে ভারত কি সরবে?

বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে উত্তেজনা চলছে ১৬ মাস ধরে। গত ১০ দিনে তা রূপ নিয়েছে গভীর এক সংকটে। দুই দেশের কূটনীতিকদের পাল্টাপাল্টি তলব, বিবৃতি অব্যাহত আছে। পাশাপাশি দিল্লি, কলকাতা, মুম্বাই ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশন অভিমুখে হিন্দুত্ববাদীরা বিক্ষোভ করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষও হয়েছে।

নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের ফলে ভারতের দিল্লিসহ অন্তত চারটি স্থানে বাংলাদেশের ভিসা সেবা বন্ধ করে দিয়েছে ঢাকা। ভারতও ঢাকাসহ চারটি স্থানে ভিসা সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছিল। এমন প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে দিল্লির সঙ্গে ঢাকার ‘সোনালি অধ্যায়ের’ ভবিষ্যৎ এখন বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

২০২৪ সালে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। দায়িত্ব পায় অন্তর্বর্তী সরকার। তখন থেকে দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততা শুরু। গত ডিসেম্বরেও দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন ও তিক্ততা ছিল। তবে সেটা এখানকার মতো এতটা উত্তেজনাপূর্ণ ছিল না। ওই সময় ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবেরা বৈঠক করেছিলেন। আবার বৈঠকের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ মিশন অভিমুখে বিক্ষোভও হয়েছে। এ বছরের ডিসেম্বরের পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশে ১১ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন আর গণভোটের তফসিল ঘোষণার পর থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে অব্যাহত উত্তেজনার ফলে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে।

মূলত ভারতের সংঘ পরিবারের অন্যতম শরিক বিশ্ব হিন্দু পরিষদসহ (ভিএইচপি) হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো গত বছরের আগস্ট থেকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগটি ইস্যু বানাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এতে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমও যুক্ত হয়েছে। ভারত পৃথিবীজুড়ে এটা বোঝাতে চেয়েছিল যে বাংলাদেশে আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক হারে নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি।

শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) প্রতি ভারতের সমর্থনেরও কোনো ছেদ পড়েনি। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পালিয়ে থাকা দলটির নেতা–কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সভা-সমাবেশে যুক্ত থেকেছেন। শেখ হাসিনাকেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়ার সুযোগ করে দেয় ভারত। একপর্যায়ে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে নিয়মিত বিরতিতে সাক্ষাৎকারও দিতে থাকেন শেখ হাসিনা। এসব সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে চ্যালেঞ্জ করছেন। তাঁর এসব বক্তব্য-বিবৃতি বাংলাদেশের নির্বাচনের পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে বলে সরকার মনে করে। তাই শেখ হাসিনাকে এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য ভারতের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গত ১৭ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের আগে–পরে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী হস্তান্তরের জন্য ভারতকে একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। দিল্লির সঙ্গে আলোচনায় ঢাকা এখন যুক্ত করেছে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শহীদ শরিফ ওসমান বিন হাদির খুনিদের ফেরত দেওয়ার প্রসঙ্গটি। ফলে শেখ হাসিনার পাশাপাশি হাদির হত্যাকারীকে ফেরত পাওয়ার ইস্যুটি দুই দেশের উত্তেজনায় যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

অন্যদিকে ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় নির্মমভাবে খুন হন পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাস। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ওই দিন রাতে দীপুকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের’ অভিযোগ তুলে এটি সামনে এনেছে দিল্লি। ফলে ইস্যুটি উপজীব্য করে ভিএইচপি ভারতজুড়ে প্রতিবাদের ডাক দেয়। সে অনুযায়ী সংগঠনটি এরই মধ্যে দিল্লি, মুম্বাই ও আগরতলায় বাংলাদেশের মিশনগুলোকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ করেছে।

১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। সেদিন তাঁকে জানানো হয়, ভারতে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের দ্রুত অবসান চায় ঢাকা। হাদিকে হত্যার চেষ্টায় (তখন হাদি চিকিৎসাধীন ছিলেন) জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা ভারতে প্রবেশ করলে তাঁদের গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোরও আহ্বান জানায় বাংলাদেশ।

প্রণয় ভার্মাকে ঢাকায় তলবের দুই দিন পর অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই দিন দুপুরে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে ‘মার্চ টু ইন্ডিয়ান হাইকমিশন’ নামে একটি কর্মসূচির ঘোষণা ছিল জুলাই ঐক্য নামের একটি সংগঠনের।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা উত্তেজনার রাশ টেনে ধরার কথা বললেও বাস্তবতা উল্টো। কয়েকবার অনুরোধের পরও দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনার বক্তৃতা, বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার প্রচার থামানো যাচ্ছে না। কারণ, দিল্লি তাঁকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এর পাশাপাশি আবার তাঁকে ফেরতও দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি ৬ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এ–ও বলেছেন, বিশেষ এক পরিস্থিতিতে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানেই থাকবেন কি না, সে সিদ্ধান্ত একান্তই তাঁর ওপর নির্ভর করছে। ফলে শেখ হাসিনার বিষয়ে এমন অবস্থানের দরুন ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের মাঝে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। পাশাপাশি হাদি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কারণে সেই ক্ষোভে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা।

২০ ডিসেম্বর রাতে হঠাৎ করেই দিল্লির চাণক্যপুরীর নিরাপত্তাবেষ্টনী এড়িয়ে বাংলাদেশ হাউসের (হাইকমিশনারের বাসভবন) উল্টো দিকে বিক্ষোভ করেন ২০ থেকে ২৫ জন। এই ঘটনা অনেককে চমকে দিয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ হাউসের অবস্থান এতটাই নিশ্ছিদ্র এলাকায় যে সেখানে বিক্ষোভকারীদের পৌঁছানোর কথা নয়।

দিল্লিতে ওই বিক্ষোভের বিষয়ে ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল এক বিবৃতিতে ওই প্রতিবেদন ‘বিভ্রান্তিমূলক’ বলে মন্তব্য করেন। পাশাপাশি তিনি পোশাকশ্রমিক দীপু হত্যার বিচারের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কথাও বলেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলোর মতে, রণধীর জয়সোয়াল ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মূলত বিক্ষোভকারীদের অবস্থানকে সমর্থন করেছেন।

দিল্লিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্থাপনার সামনে একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের বিক্ষোভের তীব্র প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। আর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের এ নিয়ে দাবিও ঢাকা প্রত্যাখ্যান করে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশন দিল্লির নিশ্ছিদ্র নিরাপদ এলাকায় অবস্থিত। এমন একটি এলাকায় রাতের বেলা ২০-২৫ জনের একটি দলকে কীভাবে ঢুকতে দেওয়া হলো!

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে এমন সন্দেহ আর অবিশ্বাস অতীতে কখনো দেখিনি। প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী উভয় দেশকেই একে অপরের কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’

নিরাপত্তা শঙ্কা ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে ভারতের পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়েছে। ১৮ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি প্রতিবেদন লোকসভায় পেশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে এই মুহূর্তে দুই দেশের সম্পর্ক যেখানে আছে, সেটিকে ১৯৭১ সালের পর সবচেয়ে প্রধান কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত গবেষণার অধ্যাপক অশোক সোয়েন বিবিসিকে বলেছেন, ভারতের গণমাধ্যমের একটি বড় অংশও বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিতভাবে তুলে ধরে দেশটি সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার দিকে যাচ্ছে বলে দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ভারতের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য।

বাস্তবতা মেনে সম্পর্ক পুনর্গঠনের তাগিদ

ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) ‘সোনালি অধ্যায় শেষে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আবার সঠিক পথে ফেরানো’ শীর্ষক ৫৩ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

আইসিজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ভারতের জন্য ছিল একটি বড় ধাক্কা। কারণ, হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে ভারত ছিল তাঁর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র। নয়াদিল্লির সমর্থন আওয়ামী লীগকে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের বৈতরণি পেরোতে সহায়তা করেছিল। কিন্তু ক্রমেই অজনপ্রিয় হতে থাকা একজন শাসকের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দেয়। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার পর বিষয়টি ভারতের জন্য প্রতিকূলতা তৈরি করে। হাসিনা-পরবর্তী যুগে যদি সম্পর্ক আরও খারাপ হয়, তবে তা সম্ভাব্য সহিংসতা উসকে দিতে পারে, দেশ দুটির অভিন্ন সীমান্তকে আরও অস্থিতিশীল করতে পারে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দেওয়া থেকে বিরত থাকা। অন্যদিকে নয়াদিল্লির উচিত নতুন করে উত্তেজনা না বাড়ানো এবং বাংলাদেশে তাদের সম্ভাব্য অংশীদারদের অবমূল্যায়ন করা থেকে দূরে থাকা।

ভারতের সঙ্গে নিজের কাজের অভিজ্ঞতায় হুমায়ুন কবীর মনে করেন, বাস্তবতা মেনে নিয়ে ভারতের উচিত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনে উদ্যোগী হওয়া। কারণ, প্রতিবেশী দুই দেশ পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল।