
ওয়ান-ইফরার বৈশ্বিক মঞ্চে প্রথম আলো এবার দুটি বিভাগে বিশ্বের সেরার স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশের ৩ হাজার সংবাদ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তার প্রধান সংস্থা ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পাবলিশার্সের (ওয়ান-ইফরা) আন্তর্জাতিক বার্ষিক সম্মেলন ‘ওয়ার্ল্ড প্রিন্টার্স সামিটে’ বাংলাদেশের একমাত্র সংবাদমাধ্যম হিসেবে এই স্বীকৃতি পেল প্রথম আলো।
এই আয়োজনের মূল অংশ ‘সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড প্রিন্ট ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫’–এ এই বছর সারা বিশ্বে মাত্র তিনটি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয়। প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক এ আয়োজনে অংশগ্রহণ করে প্রথমবারেই সর্বোচ্চ দুটি বিভাগে সেরার পুরস্কার লাভ করেছে প্রথম আলো।
বছরব্যাপী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রে বিজ্ঞাপনের নানামুখী সৃজনশীল কৌশল ও উদ্যোগের জন্য ‘প্রিন্ট অ্যাডভার্টাইজিং ক্রিয়েটিভিটি’ বিভাগে এবং জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সাহসী সাংবাদিকতা ও বছরব্যাপী এ–সংক্রান্ত নানামুখী উদ্যোগে তরুণ পাঠকদের যুক্ততার জন্য ‘নেক্সট জেন রিডার এনগেজমেন্ট’—এই দুই বিভাগে প্রথম আলো সেরার পুরস্কার পেয়েছে। অন্য আরেকটি বিভাগ ‘ফিউশন অব প্রিন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল’–এ যৌথভাবে সেরার পুরস্কার পেয়েছে আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ মেইল ও মালয়েশিয়ার নিউ স্ট্রেইট টাইমস।
জার্মানির মিউনিখ শহরের ডিজাইন অফিসেস মিউনিখ অ্যাটলাস ভেন্যুতে আজ বুধবার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে নয়টা) এ পুরস্কার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। পুরস্কার গ্রহণের পর তিনি বলেন, প্রথম আলো বছরব্যাপী জেলাভিত্তিক আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র প্রকাশের মাধ্যমে স্থানীয় সাংবাদিকতা, কর্মকৌশল ও সৃজনশীল উপস্থাপনায় এক নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছে। তিনি বলেন, এর পাশাপাশি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রথম আলোর সাহসী সাংবাদিকতা ও পরবর্তী সময়ে গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত প্রথম আলোর নানামুখী উদ্যোগ ছিল অনন্য। এসব কাজেরই স্বীকৃতি হলো বৈশ্বিক মঞ্চ থেকে বাংলাদেশের এই আন্তর্জাতিক অর্জন। এ অর্জনের মূল কৃতিত্ব প্রথম আলোর সব সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীসহ সর্বোপরি সব পাঠকের।
বিশ্বব্যাপী ওয়ান-ইফরার সদস্য, সংবাদপত্র, সাময়িকী, প্রকাশক, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন সংস্থাসহ নানা প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতা থেকে সেরাদের বেছে নেওয়া হয়। বৈশ্বিক এই মর্যাদাপূর্ণ আসরে এর আগে পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছে কলম্বিয়ার এল তিয়েম্পো, ভারতের দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, দৈনিক ভাস্কর ও আনন্দবাজার পত্রিকা, জার্মানির প্রেসে-ড্রুক উন্ড ফেরলাগস জিএমবিএইচ, সিউডকুরিয়ার জিএমবিএইচ ও ভিআরএম জিএমবিএইচ, স্পেনের দিওয়ারি আরা, ডেনমার্কের জে.পি./পলিটিকেন হাউস, নরওয়ের ভার্ডেনস গ্যাং (ভিজি), সুইডেনের ভি কে মিডিয়া এবং থাইল্যান্ডের থাইরাথ মিডিয়াসহ অন্যান্য।
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়ান-ইফরার প্রধান কার্যালয় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট ও ফ্রান্সের প্যারিসে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সংগঠন, যা তিন হাজার সংবাদ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদের প্রতিনিধিত্ব করে। এ ছাড়া ৪০টি সদস্য প্রকাশক সমিতির মাধ্যমে এটি ১২০টি দেশের ১৮ হাজার প্রকাশনার প্রতিনিধিত্ব করে। ২০১৮ সাল থেকে ওয়ান-ইফরা ‘ওয়ার্ল্ড প্রিন্টার্স ফোরাম’–এর মাধ্যমে গণমাধ্যমে উদ্ভাবন, পাঠক সম্পৃক্ততা এবং প্রকাশনায় টেকসই উৎকর্ষের জন্য আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি দিয়ে আসছে।
এ আয়োজন সম্পর্কে ওয়ান-ইফরার সিইও ভিনসেন্ট পেরেজনে বলেন, সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড প্রিন্ট ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ডস দেখিয়েছে বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং প্রায়ই চ্যালেঞ্জিং সংবাদজগতে সংবাদমাধ্যম কোম্পানিগুলো কীভাবে দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে পাঠক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে আরও শক্তিশালী সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ওয়ান-ইফরার ওয়ার্ল্ড প্রিন্টারস ফোরামের পরিচালক ইঙ্গি রাফন ওলাফসন ও অ্যাওয়ার্ডের প্রধান জুরি গুন্ডুলা উল্লাহ।
আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রে সৃজনশীলতার পুরস্কার: প্রথম আলো ২০২৪ সালে জেলাভিত্তিক আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র প্রকাশের মাধ্যমে স্থানীয় সাংবাদিকতা ও সৃজনশীল উপস্থাপনায় নতুন মানদণ্ড তৈরি করেছে। প্রতিটি সংখ্যায় শুধু সংবাদ নয়, বরং জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, উৎসব, খাবার, বিনোদন, শিল্প-সাহিত্য ও মানুষের জীবনযাত্রাকে অনন্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে স্থানীয় অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ, নারী ও যুব উদ্যোক্তা, গ্রামীণ উন্নয়ন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতির নানা দিক। প্রতিটি বিষয়কে বৈচিত্র্যময় উপস্থাপন করা হয়েছে, যা পাঠকের কাছে বিভিন্ন জেলাকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ দিয়েছে। স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্র্যান্ডগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে পাঠকেরা একদিকে তথ্য পেয়েছেন, অন্যদিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও নতুন আস্থা ও সংযোগের সুযোগ পেয়েছেন। এই ধারাবাহিক প্রকাশনার মাধ্যমে প্রথম আলো আঞ্চলিক সাংবাদিকতা, আধেয় প্রদান ও বিজ্ঞাপন উপস্থাপনায় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
প্রথম আলোর বছরব্যাপী আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র ভিন্নমাত্রায় প্রকাশের এই সৃজনশীল উদ্যোগ বর্তমানে স্থানীয় উন্নয়নকে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার এক শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় স্থানীয় পাঠক, ব্যবসায়ী ও শুভানুধ্যায়ীদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে প্রথম আলো সাহসিকতার সঙ্গে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ খবর ছাপা পত্রিকায় প্রকাশ করেছে। স্বৈরাচারী সরকারের শাসনামলে নানামুখী চাপ সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে সত্য ও সাহসী প্রতিবেদন প্রকাশ করে গেছে প্রতিনিয়ত, ফলে প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত হন নানামুখী পাঠক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাপা পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বেড়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার কপি। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান নিয়ে বছরব্যাপী নানামুখী সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রথম আলো, যাতে যুক্ত হয় নতুন প্রজন্মসহ নানামুখী মানুষ। এসবের মধ্যে ছিল আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া কেন্দ্রীয় পাঁচটি বিশেষ ক্রোড়পত্র, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ থেকে আঞ্চলিক চারটি বিশেষ ক্রোড়পত্র, প্রথম আলোর আলোকচিত্রীদের তোলা আন্দোলনের বাছাই ছবি নিয়ে মুক্ত করো ভয় শিরোনামে ফটোজার্নাল, ক্যামেরায় বিদ্রোহ শিরোনামে পাঠক সংযোগ প্রচারণা, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে চারটি তথ্যচিত্র নির্মাণ, এ বছরের ২৪ থেকে ৩১ জানুয়ারি ‘জুলাই-জাগরণ’ শিরোনামে শিল্পকলা একাডেমিতে বিশেষ প্রদর্শনী, গণ-অভ্যুত্থানের তথ্য-ছবি-ভিডিও নিয়ে ওয়েবসাইট এবং প্রথম আলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশন থেকে আন্দোলন সম্পর্কিত ছয়টি বই প্রকাশসহ নানামুখী কর্মকাণ্ড। প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ক্যাম্পেইন প্রচারণাও ছিল এ আন্দোলনের থিমের ওপর, যা তরুণ পাঠকদের যুক্ত করেছে।
সংবাদমাধ্যমের জন্য বিশ্বমঞ্চের অন্যান্য মর্যাদাপূর্ণ আসর থেকেও এর আগে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে প্রথম আলোর। ওয়ান-ইফরার অঞ্চলভিত্তিক আয়োজন ‘দক্ষিণ এশীয় ডিজিটাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস’–এ প্রথম আলো বিগত বছরগুলোতে ২টি সোনাসহ মোট ১১টি পুরস্কার লাভ করেছে। এ ছাড়া ১০০টির বেশি দেশের এক হাজারের অধিক সংবাদমাধ্যমের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের (ইনমা) বৈশ্বিক আয়োজন ‘ইনমা গ্লোবাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস’–এ বিশ্বের ছয়টি অঞ্চল থেকে ছয় সেরার ভেতর ‘দক্ষিণ এশিয়ার সেরা’ ছাড়াও ২টি প্রথম পুরস্কারসহ এখন পর্যন্ত মোট ১১টি পুরস্কার পেয়েছে প্রথম আলো।
দুই দিনব্যাপী ‘ওয়ার্ল্ড প্রিন্টার্স সামিট’ আজ জার্মানির মিউনিখে শুরু হয়। এখানে ছাপা কাগজের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। নতুন নতুন সম্ভাবনার কথাও আলোচনায় উঠে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা এবারের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে এই সামিটে অংশগ্রহণ করছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং মহাব্যবস্থাপক ও হেড অব মার্কেটিং আজওয়াজ খান। সম্মেলন শেষ হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার।